আহ্নিক গতির নিয়মে পৃথিবী আলোকিত হয় আবার অন্ধকার হয়। সময়ের পরিক্রমার মাঝে যখন চারিদিকে উত্তেজনা, সংঘাত, নিপীড়নের হাহকার এবং প্রোপাগান্ডার অন্ধকার আমাকে বিষণ্ণ করে। তখন গানের সুরের ভিতর দিয়ে চেনাকে অচেনার মাঝে, সহজকে কঠিনের মাঝে খুঁজে পাই। এ লেখায় আমি এমন একজনের কথা বলতে চাই যার গানে শুধু ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবন যুদ্ধের কথা ও প্রেম-ভালবাসা নয়, কুসংস্কারমুক্ত এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজের কথাও বলা হয়েছে।
ভূপেন হাজারিকার গানে পদ্মার মানুষের হাহাকারের কথা শুনেছি। আর বর্ষায় উজানের পানি নেমে এসে প্লাবিত করে দেয়া হাওর অঞ্চলের মানুষের চোখের কোণে জমে থাকা গভীর দুঃখের কথা যেই মানুষটির গানে উঠে এসেছে, তিনি ‘ভাটির পুরুষ’ হিসেবে পরিচিত শাহ আবদুল করিম। তিনি লোক সংগীতের এক মহাপুরুষ। তথাকথিত দেহতত্ত্বের প্রচারের পাশাপাশি তিনি একজন সমাজ সংস্কারক এবং সামাজিক আন্দোলনের পথপ্রদর্শক ছিলেন।
কত গান গেয়ে গেলেন যারা মরমী কবি
আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখ-দুর্দশার ছবি
বিপন্ন মানুষের দাবি করিম চায় শান্তির বিধান
মন মজালে ওরে বাউলা গান
শাহ আবদুল করিম, ১৯১৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি, সুনামগঞ্জের দিরাই থানার ধলআশ্রম গ্রামে অতি দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা তাই পড়াশোনার প্রবল ইচ্ছা থাকলেও রাখালবালক হিসেবে জমিদার বাড়িতে চাকরি করেছেন। বৃটিশ আমলে ভাটি অঞ্চলে এক নৈশ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। কিছু দিনের মাঝে বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যায় এক গুজবকে কেন্দ্র করে। এই বিদ্যালয়ে পড়লে নাকি বৃটিশ সৈন্যদের সাথে গিয়ে জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। তাঁকে বিদ্যালয় ত্যাগ করতে হয়। শাহ আব্দুল করিম একজন স্বশিক্ষিত মানুষ। তাঁর গানের হাতেখড়ি দাদার নসিবউল্লাহর মাধ্যমে। তাঁর দাদার গান হৃদয়ে আবেগ সঞ্চার করে। দাদার কাছে আরও অনেক গান শুনেছেন এবং একতারা বাজানো শিখেছেন।
ভাবিয়া দেখ মনে
মাটির সারিন্দা রে বাজায় কোন জনে..
ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনগাথা তাঁর মাঝে গভীর ছাপ ফেলে। হওড়ের মানুষ, পানি, নৌকা, মাটি, স্রোত তাঁর গানের প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠে। আব্দুল করিমের জীবন অর্থনৈতিকভাবে তেমন সচ্ছল ছিল না। জীবনের নানা প্রতিকূলতা তাঁকে গান থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। কলকাতার জনপ্রিয় লোক গানের দল ‘দোহার’ এর কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য, শাহ আব্দুল করিমকে নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন,“শাহ আব্দুল করিম এমন এক সমাজের কথা চিন্তা করেন, যে সমাজের সবাই লালন হবে।”
গানের জন্য মানুষটি হয়েছেন কূলহারা কলঙ্কিনী। গ্রামের মানুষ গান-বাজনা পছন্দ করে না। তাই তাঁকে সমালোচনার স্বীকার হতে হয়েছে, অনেকে আবার গান ছাড়ার কথা বলেছে। কিন্তু তাঁর একটাই কথা, তিনি গান ছাড়বেন না। নিজের সাথে তিনি ছলনার আশ্রয় নেননি। তাদের কথার জবাব তিনি দিয়েছেন গানে-
পরে করিব যাহা এখন যদি বলি করব না,
সভাতে এই মিথ্যা কথা বলতে পারব না।
শাহ আব্দুল করিমের জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো গান ত্যাগের কথা আসে যখন তাঁর প্রথম স্ত্রীর পরিবার থেকে ‘গান কিংবা স্ত্রী’ এমন শর্তের কথা বলা হয়। কিন্তু গান পাগল মন কি গান ছাড়া থাকতে পারে। তাই তো গেয়েছেন –
গান গাই আমার মনরে বুঝাই,
মন তাতে পাগলপারা।
আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া, গান ছাড়া…
তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয় মমজান বিবির সাথে। পরবর্তীতে মমজান বিবির সাথে বাকি জীবন কাটান। ভালবেসে তাকে ‘সরলা’ ডাকতেন। গানের জন্য আব্দুল করিম দূর-দূরান্তে যেতেন। মমজান সংসার আগলে রেখেছেন একা। অভাব-অনটনের মাঝে থেকেও কোন দিন ছেড়ে যাওয়া কথা ভাবেনি। মমজানের প্রতি গভীর ভালবাসা থেকে সৃষ্টি করেছেন অনেক গান, যার মধ্যে রয়েছে– ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’, ‘নতুন প্রেমে মন মজাইয়া’। ১৯৯৭ সালে মারা যান সরলা। তাঁর স্ত্রী’র সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেছেন, “আজকের এই করিম কখনোই করিম হয়ে উঠতে পারতো না যদি কপালের গুণে সরলার মতো বউ না পেতাম ।”
মৃত্যুর সময় তাঁর পাশে থাকতে পারেননি তিনি। তাঁর কথা অনুযায়ী সরলার কবর তাঁর বাড়ির সামনে। পত্নী বিয়োগে সৃষ্টি করেছেন‘কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া’, ‘কেন পিরীতি বাড়াইলা রে বন্ধু’ এর মতো গান।
শাহ আব্দুল করিম সব সময় হিন্দু-মুসলিম একসাথে মিলিত সমাজের কথা বলেছেন। তিনি অনুসারীদের বলতেন-
আমার হিন্দু-মুসলিম এটা বড় কথা নয়, আমরা বাঙালি; আমরা মানুষ
আব্দুল করিমের ‘আমি বাংলা মায়ের ছেলে’ গানটি এ কথারই প্রতিছব্বি। তাঁর গান ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ এমন এক সমাজের কথা বলেন যে সমাজে কোন বৈষম্য নাই, পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া আছে। এমন গান যিনি রচনা করেন তিনি কত বড় মানের একজন দার্শনিক তাতে কোন সন্দেহ নাই। লালনতত্ত্বের অর্থাৎ দেহতত্ত্বের কথাও উঠে এসেছে আব্দুল করিমের অনেক গানে। তিনি কখনও নৌকা আবার কখনও গাড়ির সাথে তুলনা করেন মানবজীবনকে। যেমন- ‘ঝিলঝিল ঝিলঝিল করেরে ময়ুরপংখী নাও’, এবং ‘গাড়ি চলে না’ ।
তাঁর দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির যেমন ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে ঠিক তেমনি তাঁর গানে রয়েছে সমাজচেতনা ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। ধর্মীয় গোঁড়ামি, বৈষম্য এবং অবিচার বিরুদ্ধে হাতিয়ার হতে পারে শাহ আব্দুল করিমের গান।
Featured Image: noakhalirkatha24.com