পশ্চিমা সংগীতের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল যুগ বলা হয় ষাটের দশককে যখন বিশ্বজুড়ে রক কালচারে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলো শ্রোতারা। যেসকল মিউজিকাল হ্যামেলিনদের কারণে রক সংগীত বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে তাদের মাঝে বিমোহিত করার মত একটি ব্যান্ড ‘কুইন’ (Queen)। সৃজনশীল সৃষ্টির নৈপুন্য বা ইংরেজিতে যাকে বলে (Creative destruction) এবং গানের নিত্যনতুন অনুসন্ধান তাদের কিংবদন্তির কাতারে নিয়ে এসেছে। রক সঙ্গীতের নতুন ধারা- রক অপেরা এর অঙ্কুরোদগম হয় এই কুইন ব্যান্ডের মাধ্যমে।
রক সংগীতের সব থেকে স্মরণীয় এবং প্রভাব বিস্তারকারী গানের তালিকায় হয়ত উপরের দিকে থাকবে কুইনের ‘বোহেমিয়ান র্যাপসোডি’ গানটি। বহুমাত্রিকতার এক অনন্য সৃষ্টি কুইন ব্যান্ডের ছয় মিনিটের এ গান যেটি লিখেছেন রক সংগীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, কুইন ব্যান্ডের ভোকালিস্ট ফ্রেডি মার্কারি। তাঁর শক্তিশালী তিন অক্টেভ ভোকাল রেঞ্জ, অভিব্যক্তি এবং সিগনেচার মঞ্চ পরিবেশনার জন্য আজও আমরা মুগ্ধ হয়ে তার গাওয়া গান শুনি। ‘বোহেমিয়ান র্যাপসোডি’ গানটিকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। তাই আজ জানার চেষ্টা করবো, কেন এই গানটি আলাদা!
বোহেমিয়ান র্যাপসোডি গানটিতে কোনো কোরাস ছিল না, গঠন এবং শব্দ সংযোজনের দিক থেকে গানটি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। প্রথাগত সংগীতের ধারণার বাহিরে এক নতুন সংযোজন যা কিনা কয়েকটি ভিন্ন ধারার গানকে একত্রিকরণ করেছে। কেবল প্রোগ্রেসিভ অথবা হার্ডরক নয়, বরং প্রোগ্রেসিভ রক, হার্ডরক, এবং ওপেরাটিক রক একসাথে সংযুক্ত করা হয়েছে এই গানটিতে। সার্বিক দিক থেকে ছয় মিনিটের গানটির গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি ভাগ রয়েছে- ইন্ট্রো, ব্যালাড, ওপেরা, রক এবং আউট্রো। প্রতিটি ভাগ আলাদাভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। গানের ইন্ট্রোটি ‘আ কাপ্পেলা’ (A Cappella) ধাঁচে করা। এ ধাঁচে কোন প্রকার বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার না করে গানটি গাওয়া হয় এবং সাধারণত একাধিক গায়ক/গায়িকা এতে অংশ নেয়। দ্বিতীয় ভাগে ‘ব্যালেড’ যেখানে একটি কাহিনি বর্ণনা করা হয়। এরপরের অংশটি ‘সিম্ফোনিক ওপেরা’ যেখানে গলা দেন ব্রায়ান মে, রজার টেইলর, এবং ফ্রেডি মার্কারি এবং শেষের অংশটি ‘হার্ডরক’ ধাঁচের করে পুরো গানটির সামঞ্জস্য আনা হয়।
গানটির আরেক বিশেষত্ব হল এর দুর্বোধ্যতা। গানটি সাদামাটা মনে হলেও বিশ্লেষণ করা বেশ কঠিন। গানটি লিখছেন ফ্রেডি নিজে কিন্তু তিনি গানেটির অর্থ অস্পষ্ট রেখেছেন সর্বসমক্ষে। তিনি গানটি সম্পর্কে বলেছেন যে এই গানে তিনি সৃজনশীলতা প্রদর্শন করেছেন। কুইনের গিটারিস্ট ব্রায়ান মে’র কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “গানটি তাঁর (ফ্রেডি মার্কারি) শিল্পবোধ এবং কল্পনাশক্তির বহিঃপ্রকাশ।” ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের দেশ ইরান; যেখানে পশ্চিমা গানের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, সেই ইরানে ১৯৮১ সালে ‘কুইন গ্রেটেস্ট হিটস’ মুক্তি পায়। ক্যাসেটে গানের অনুবাদ এবং ব্যাখ্যায় বলা হয় যে, “একজন বালক ঘটনাক্রমে আরেকজনকে খুন করে এবং মৃত্যুদণ্ডের পূর্বে আল্লাহ নিকট ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আত্মার মুক্তি কামনা করে।” অনেক সমালোচক আবার বলেছেন যে, গানটিতে আদালতে খুনের অপরাধের দণ্ডপ্রাপ্ত বালকের ঘটনাপ্রবাহ। ফ্রেঞ্চ লেখক আলবেয়ার ক্যামুর ‘ল্যা-এস্রানজার’ (দ্য স্ট্রেঞ্জার) উপন্যাসের কাহিনীর সাথেও মিল পাওয়া যায় গানের; যেখানে উপন্যাসের মূল চরিত্র খুন করার পরে মৃত্যুদণ্ড পায়। গানের মর্মার্থ সম্পর্কে ফ্রেডি কোনো বিবৃতি করেননি, অনেকে ধারণা করেন গানের মাধ্যমে ফ্রেডি শুধু তার নিজের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করেছেন। তিনি নৈরাশ্যবাধকে জুড়ে দিয়েছেন গানের অনুষঙ্গ হিসেবে। তাই এই গানকে কোনো স্বীকারক্তি হিসেবে ধারণা না করে, বরং সমকালীন রক সংগীতের অন্যতম সৃষ্টি বলে মনে করাটাই শ্রেয়।
ফ্রেডি মার্কারির গানে তাঁর সাহিত্য ও শিল্পের শৌর্য প্রকাশ পায়। বোহেমিয়ান র্যাপসোডি গানে অপেরাটিক অর্থাৎ তৃতীয় স্তবকে স্ক্যারামুস (SCARAMOUCHE) এর নাম নেয়া হয়েছে। এটি ইতালির থিয়েটারের বিখ্যাত একটি চরিত্র যার পোশাক বিন্যাস ছিল অদ্ভুত। কালো মাস্ক কালো ট্রাউজার, শার্ট, এবং মাথায় হ্যাট। স্ক্যারামুসকে ফানডাঙ্গ (Fandango) করার কথা কথা বলা হয়। ফানডাঙ্গ হল স্প্যানিশ যুগ্ম নৃত্য। কুরআন থেকে বিসমিল্লাহ (Bismillah) ব্যবহার করা হয় যা ফ্রেডির স্পিরিচুয়ালিটি কথা বলে। ফ্রেডি ব্যক্তিগতভাবে জরথুস্ট্র-পন্থী ছিলেন, এই ধর্মের মূল বিশ্বাস একেশ্বরবাদ। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও যাকে কিনা ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে সাজা দেওয়া হয় তার কথাও উল্লেখ আছে এই স্তবকে। ফ্রেডি মার্কারি ওপেরা প্রেমী ছিলেন মনেপ্রাণে। মোজার্টের ‘দ্যা ম্যারেজ অফ ফিগারো’ এর কথাও উল্লেখ করেছে এই স্তবকে। এগুলো থেকেই বোঝা যায় সাহিত্য, ধর্ম ও শিল্প সম্পর্কে কতটা জ্ঞান ছিলো ফ্রেডি মার্কারির।
আরও পড়ুনঃ কনসার্ট ফর বাংলাদেশ: মানবতার ডাকে সংগীতের সাড়া
পরিশেষে ‘কুইন’ ব্যান্ডটির কথা বলতে গেলে বলতে হয়, এই কিংবদন্তী ব্যান্ডটির সংগীত জগতে রয়েছে অভাবনীয় অবদান। যার প্রভাব বাংলাদেশের সংগীতে দেখা যায়। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের রকস্টার জেমসের ‘দুরন্ত মেয়ে’ গানটি মুক্তির পর খুব জনপ্রিয়তা পায়। গানটি কুইন ব্যান্ডের ফ্রেডি মার্কারির গাওয়া ‘আই ওয়ান্ট টু ব্রেক ফ্রী’ সুরের সাথে মিল রেখে রচনা করা হয়। এছাড়া ‘উই আর দ্য চ্যাম্পিয়ানস’ (We are the champion) গানটি ক্রীড়া অনুষ্ঠানে বিজয়ের আন্থেম হিসেবে স্বীকৃত।
ফ্রেডি মার্কারির সংগীত জীবনের রহস্য সিনেমার পর্দায় উপস্থাপনার জন্য তাঁর জনপ্রিয় গান বোহেমিয়ান র্যাপসোডি শিরোনামে তাঁর জীবনভিত্তিক সিনেমা নির্মাণ করেছে বিখ্যাত প্রযোজক এবং চিত্রনাট্যকার অ্যান্থনি ম্যাককার্টেন। এটি সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে বিশ্বব্যাপী। আজও রকপ্রেমী শ্রোতারা উন্মাদ এবং বিমোহিত ফ্রেডি মার্কারির জন্য।
Featured image: direstraitsblog.com