সত্তর এর দশকে গড়ে ওঠা তুমুল জনপ্রিয় একটি পপ-রক ব্যান্ড মাইলস। মাইলসের কালজয়ী কিছু গান কানে পড়ে হরহামেশাই। টং এর আড্ডায় কিংবা টিএসসির পড়ন্ত বিকেলে, কখনও বা একলা রাতে কখনও বা সোডিয়াম বাতির গানে, মাইলসের অনুপস্থিতি নেই কোথাও। চাঁদের গাড়ির ছাদে বা ভরা পূর্ণিমায় লঞ্চে; চাঁদ তারা সূর্য, নষ্ট অতীত, হৃদয়হীনা, প্রথম প্রেমের মত; গাওয়া চলছে সেই শুরু থেকেই। প্রেয়সীর কাছে কঠিন আবদারের বেলায় নীলা, ফিরিয়ে দাও এর মত গানের জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশের সংগীতপ্রেমীদের মনে পপ-রক গানের জন্য ভালবাসা সঞ্চারে যে কয়েকটি ব্যান্ড ভূমিকা রেখেছে মাইলস তাদের মাঝে অগ্রগণ্য। গিটার কিংবা ইউকেলেলের টুং-টাং এ তরুণ হৃদয়ে মাইলস এর জায়গা ধ্রুব।

মাইলসের পাঁচ সদস্য একসাথে; বাম দিক থেকে হামিন, জুয়েল, সাফিন, মানাম, তূর্য;
মাইলসের পাঁচ সদস্য একসাথে; বাম দিক থেকে হামিন, জুয়েল, সাফিন, মানাম, তূর্য; Source: Facebook (Miles)

যেভাবে যাত্রা শুরু মাইলসের

১৯৭৯ সালে ফরিদ রশিদের হাত ধরে মাইলস ব্যান্ড এর সূচনা। ফরিদ রশিদ লিড ভোকালস এবং বেজে, ল্যারি ও ইশতিয়াক গিটারে, কামাল মাইনুদ্দিন ড্রামসে ও হ্যাপি আখন্দ কীবোর্ডে— এই লাইন আপ নিয়ে যাত্রা শুরু মাইলসের। তখন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গান পরিবেশন করত মাইলস। মাইলসের এর বর্তমান সদস্য মানাম আহমেদ এর মতে, তাদের সংগীত ল্যাটিন, জ্যা, রক ও টেকনো মিউজিক দ্বারা অনুপ্রাণিত; তাই তাদের গান মূলত রক ধারার হলেও নানা ধরনের মিউজিক এর বেশ সুন্দর মেল বন্ধন দেখা যায়। তাদের প্রথম অ্যালবাম মাইলস প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। পাঁচটি অরিজিনাল ও সাতটি কাভার ট্রাক নিয়ে এই অ্যালবামই দেশের প্রথম ইংরেজী অ্যালবাম। এটিই মাইলস ব্যান্ড এর একমাত্র অ্যালবাম যেটিতে ব্যান্ড এর সকল প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এরপর একে একে প্রকাশিত হতে থাকে তাদের অ্যালবামগুলো। নব্বই এর দশকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে স্থান করে নেয় মাইলস। ১৯৯৩ সালে তাদের দ্বিতীয় বাংলা অ্যালবাম প্রত্যাশা প্রকাশিত হয় যা প্রায় ৩ লক্ষ কপি বিক্রয় হয় এবং এখনও এই অ্যালবাম দেশের অন্যতম বেস্ট সেলিং অ্যালবাম। ১৯৯৪ সালে তারা বেস্ট অফ মাইলস নামে সিডি প্রকাশ করে।

১৯৯৩ সালে প্রত্যাশা অ্যালবামের ফটো শুটের সময়
১৯৯৩ সালে প্রত্যাশা অ্যালবামের ফটো শুটের সময় © Imtiaz Alam Beg

এক নজরে মাইলস এর অ্যালবামসমূহ

  • মাইলস (১৯৮২)
  • এ স্টেপ ফারদার (১৯৮৬)
  • প্রতিশ্রুতি (১৯৯১)
  • প্রত্যাশা (১৯৯৩)
  • প্রত্যয় (১৯৯৬)
  • প্রয়াস (১৯৯৭)
  • প্রবাহ (২০০০)
  • প্রতিধ্বনি (২০০৬)
  • প্রতিচ্ছবি (২০১৫)

এছাড়াও রয়েছে সমন্বিত অ্যালবাম বেস্ট অফ মাইলস (১৯৯৪) ও এক্সটেন্ডেড প্লে অ্যালবাম প্রবর্তন (২০১৬)

বামবার কনসার্টে বাজাচ্ছেন হামিন আহমেদ
বামবার কনসার্টে বাজাচ্ছেন হামিন আহমেদ © রাজীব হাসান

মাইলসের বর্তমান সদস্যরা

শাফিন আহমেদ- লিড ভোকালস ও বেজ
হামিন আহমেদ- লিড গিটারিস্ট ও ভোকালস
মানাম আহমেদ- কীবোর্ড
ইকবাল আসিফ জুয়েল- গিটারিস্ট ও ব্যাক আপ ভোকালস
সৈয়দ জিয়াউর রহমান তূর্য- ড্রামস

দেশের জনপ্রিয় কীবোর্ডিস্টদের একজন মানাম আহমেদ
দেশের জনপ্রিয় কীবোর্ডিস্টদের একজন মানাম আহমেদ © রাজীব হাসান

মাইলস গঠন ও সদস্যদের আনাগোনা

১৯৭৫ সালে স্পন্দন থেকে বেরিয়ে হ্যাপি আখন্দ যখন নিজের ব্যান্ড শুরু করার কথা ভাবছিলেন, এমন সময় তাঁর পরিচয় হয় বেজিস্ট ফরিদ রশিদ এর সাথে; সাথে জুড়লেন ল্যারি ও কামাল মাইনুদ্দিন, এভাবে দুয়ে দুয়ে চার মিলে শুরু হল মাইলসের পথচলা। পরে হামিন আহমেদ ও মানাম আহমেদ যোগ দেন ব্যান্ডে। ১৯৮৭ সালে হ্যাপি আখন্দের মৃত্যুর পর ব্যান্ড একটা সংকটময় সময় কাটাচ্ছিল। ঐ বছরই হঠাৎ ফরিদ ও কামাল, দুজনই পরিবারিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। মাইলসের তখন শুধু হামিন ও মানাম। তবে মানাম শ্রুতি স্টুডিওর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় মাইলসকে আকড়ে রেখেছিলেন একমাত্র হামিন। এক সাক্ষাৎকারে হামিন বললেন, “তখন মনে হচ্ছিল, পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। তখন জাতীয় দলে ক্রিকেট খেলতাম। গানের জন্য ক্রিকেট ছেড়ে মাইলসে যোগ দিলাম। সেই দলই ভেঙে যাচ্ছে!” তবুও মাইলস ছাড়েননি তিনি, একাই ধরেছিলেন ব্যান্ডের হাল। ডেটা টেক নামে কম্পিউটারের ব্যবসা শুরু করে, আয় করা অর্থ দিয়ে ব্যান্ডের কার্যক্রম চালিয়েছেন। তখন অস্থায়ীভাবে খায়েম (বেজ) ও শামীমকে (ড্রামস) নিয়ে হামিন ও মানাম মঞ্চে উঠতেন মাইলসের শ্রোতাদের জন্য। একসময় ড্রামার হিসেবে মিল্টন যোগ দিলেন ব্যান্ডে।

মাইলসের ৪০ বছরপূর্তি কনসার্টে শাফিন আহমেদ
মাইলসের ৪০ বছরপূর্তি কনসার্টে শাফিন আহমেদ; Source: Facebook (Miles)

শাফিন আহমেদ তখন যুক্তরাজ্যে লেখাপড়া করতেন। ১৯৮৯ সালে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরেই মাইলসে রিদম গিটারিস্ট হিসেবে যোগ দিলেন তিনি। ব্যান্ডে বাজাতে বেশ ভালই লাগছিল শাফিনের, তাই ঢাকাই থেকে যাবেন নাকি লন্ডনে ফিরবেন তা নিয়ে দোটানায় ছিলেন তিনি। অবশেষে সংগীতের টানে একেবারে দেশে চলে আসেন শাফিন আর মাইলসে প্রধান ভোকালিস্ট ও বেজিস্ট হিসেবে যোগ দেন।

মঞ্চে মাইলসের আরেক গিটারিস্ট জুয়েল
মঞ্চে মাইলসের আরেক গিটারিস্ট জুয়েল © রাজীব হাসান

প্রায় বছর খানেক পর তাদের তৃতীয় অ্যালবাম প্রতিশ্রুতি মুক্তি পায় এবং ভাল সাফল্য অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে আরোও দু’জন সদস্য যোগ দেন মাইলসে। তারা হচ্ছেন জুয়েল (গিটার) ও তূর্য (ড্রামস)। এরপর থেকে বেশ ভালভাবেই এগিয়ে চলছিল মাইলস। ২০০৯ সালে ব্যান্ড এর মালিকানা নিয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে মাইলস ছাড়েন শাফিন। পরবর্তী কিছু বছর সংকটে কাটলেও ২০১৩ সালে শাফিন মাইলসে ফিরে আসলে পুরনো লাইন আপেই চলতে থাকে মাইলস। তবে ২০১৭ সালের শেষ দিকে শাফিন আরো একবার মাইলস ছাড়েন। এ সময়ে একক শিল্পী হিসেবে কিছু কাজ করেন তিনি। ২০১৮ সালের শেষার্ধে আবারও তিনি ফিরে আসেন মাইলসে এবং এখন পর্যন্ত ব্যান্ডটির সাথেই আছেন।

ড্রামসে ঝড় তোলেন তূর্য
ড্রামসে ঝড় তোলেন তূর্য © রাজীব হাসান

চার দশক পার করল মাইলস

গত বছর চার দশক পূরণ করে মাইলস। বিগত ৪০ বছরে ব্যান্ডটি বাংলাদেশের রকপ্রেমি শ্রোতাদের উপহার দিয়েছে অসাধারণ কিছু গান, দেশের রক সংগীতকে দিয়েছে এক অন্য মাত্রা। সর্বপ্রথম স্পন্সরশিপ নিয়ে দেশের বাইরে কনসার্ট করা ব্যান্ডও মাইলস। দেশের বাইরে মাইলসের রয়েছে অনন্য শ্রোতামহল। ৪০ বছর এর মাইলফলক অর্জনে কনসার্ট ট্যুর এর আয়োজন করেছিল মাইলস। গত বছর জুনে ইউএস ট্যুরের মধ্য দিয়ে তাদের এ কনসার্ট ট্যুর শুরু হয়। এ ট্যুরের অংশ হিসেবে মাইলস ২৪টি ইন্টারন্যাশনাল কনসার্টে বাজিয়েছে। কনসার্টগুলোর ১৮টি ইউএসএ,৭টি কানাডা ও ৩টি অস্ট্রেলিয়ায় হয়েছে। ২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় গালা কনসার্ট এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় তাদের ৪০ বছরপূর্তির আয়োজন।

চার দশক পরও গানের মাধ্যমে জাদু ছড়াচ্ছে মাইলস
চার দশক পরও গানের মাধ্যমে জাদু ছড়াচ্ছে মাইলস; Source: Facebook (Miles)

এতগুলো বছর পেরিয়েও শ্রোতা হৃদয়ে মাইলসের জন্য ভালবাসার কমতি হয়নি এতটুকুও। কনসার্টগুলোতে মাইলসের সাথে গলা মিলিয়ে এক দল তরুণ বারবার মনে করিয়ে দেয়, মাইলস ছিল-আছে-থাকবে। এভাবেই হাজার বছর বেঁচে থাকুক এই গান পাগল বাঙালি মনন সেই সাথে বাঁচিয়ে রাখুক মাইলসকে।

Featured Image: © Imtiaz Alam Beg
Author:Tasnim Rahman
Tasnim Rahman is a Health Economics student at the University of Dhaka. To her, music is something which doesn’t confine to any particular occasion. It soothes souls regardless of mood. Music is a food for soul to her.
This Bengali write-up tells about the journey of the renowned Bangladeshi band Miles.
Previous articleগানের মাধ্যমে ওল্ড ব্রিগেডের প্রতিবাদ
Next articleদেশে প্রথম স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ব্যান্ডের লড়াই
Guest Author
This article is written by a guest author. You can also write for us. You can send your article via our contact form or directly via email.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.