মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াল সময়ে যে মানুষগুলো বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে, বিশ্বের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার ও নিপীড়নের কথা পৌঁছে দিয়ে, ভারতে আশ্রয় নেয়া রিফিউজি ক্যাম্পে মানবেতর জীবন কাটানো মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে তাঁদেরই একজন বিখ্যাত সেতারবাদক পন্ডিত রবিশঙ্কর। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট, বিটলসের গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজিত কনসার্ট ফর বাংলাদেশ নামের দাতব্য কনসার্ট হতে অর্জিত সকল অর্থসাহায্য দান করে দাঁড়িয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষদের পাশে, তৈরী করেছিলেন মানবতার দৃষ্টান্ত।
রবিশঙ্করের জন্ম ও বেড়ে ওঠা
১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশের বেনারসে বাবা শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী ও মা হেমাঙ্গিনী দেবীর ঘরে জন্ম বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী, সুরকার ও সেতারবাদক রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরীর। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল নড়াইলের কালিয়া উপজেলায়। স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম নেয়া রবিশঙ্কর চার ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন সবার ছোট। কিন্তু বাবা বিদেশে পাড়ি জমালে শুরু হয় কষ্টের দিনাতিপাত। রবিশঙ্করের বাবা রাজস্থানের ঝালাওয়ারের মহারাজার অধীনস্ত দেওয়ান হিসেবে মাসিক দু’শো টাকা বেতনে চাকরি করলেও নানা হাত ঘুরে মাস শেষে পৌঁছাত মাত্র ষাট টাকা। অভাবের সংসারে উপায়ন্তর না পেয়ে কানের দুল ও নাকের নথ বন্ধক রেখে সংসারের খরচ যোগান দিতেন রবিশঙ্করের মা। এভাবেই অর্থকষ্টে বেড়ে ওঠেন আজকের বিখ্যাত সেতারবাদক রবিশঙ্কর।
নৃত্যশিল্পী থেকে সেতারবাদক রবিশঙ্কর
নৃত্যশিল্পী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বড় ভাই উদয় শঙ্কর রবিশঙ্করকেও নাচের দলে যোগ দিতে বলেন। একদিকে সংসারে টানাপোড়েন, অন্যদিকে কম বয়স- বলা যায় ঝোঁকের বশেই রাজি হয়ে যান রবিশঙ্কর। ১৮৩০ সালে ১০ বছর বয়সে বড় ভাইয়ের নাচের দলের সাথে প্যারিস ভ্রমণ করেন তিনি। তিন বছরের মাথায়ই নাচের দলের সদস্যপদ লাভ করেন। নাচে পারদর্শী হয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রামের মারফতে ভ্রমণ করেন ইউরোপ ও অ্যামেরিকা। এমনই এক ভ্রমণকালে ইউরোপে তাঁদের নাচের দলের সাথে যোগ দেন মাইহার রাজদরবারের প্রধান সংগীতশিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান। ঠিকমতো তালিম পেলে এই ছেলেই যে একদিন বিশ্বজয় করবে তা রবিশঙ্করকে দেখা মাত্রই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। ফলস্বরূপ রবিশঙ্করকে একজন একক সেতারবাদক হিসেবে তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে জুড়ে দেন এক শর্ত। শিক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই শিক্ষায় তাঁকে থাকতে হবে একনিষ্ঠ। ইউরোপ ভ্রমণ শেষে নৃত্যদল ত্যাগ করে তালিম নিতে মাইহারে চলে যান রবিশঙ্কর। মাইহারে যাওয়ার পর মনোযোগ দিয়ে সেতারবাদন শিখতে শুরু করেন তিনি। সেতার শেখার প্রতি তাঁর একাগ্রতা আর নিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ হন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান। সেসময় ওস্তাদের পুত্র বিখ্যাত সরোদ শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ-এর সহচর্যে আসেন পন্ডিত রবিশঙ্কর। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৪ সাল অবধি ওস্তাদের বাড়িতে থেকেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের আদ্যোপান্ত আয়ত্ত করেন তিনি।
রবিশঙ্করের পারিবারিক জীবন
পন্ডিত রবিশঙ্করের বৈবাহিক জীবনের শুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কন্যা অন্নপূর্ণা দেবীর সাথে। বাবা আর ভাইয়ের মতো অন্নপূর্ণা দেবীও ছিলেন অত্যন্ত গুণী এক সেতারবাদক। একই বাড়িতে থাকার সুবাদে আগে থেকেই পরিচয় ছিল দুজনের। পারিবারিকভাবেই ১৯৪১ সালের ১৫ মে বিবাহ সম্পন্ন হয় এই দম্পতির। বিয়ের কিছুদিন পর অন্নপূর্ণা দেবীর তুমুল জনপ্রিয়তা, সম্পদের অসম বন্টন আর তাঁদের পুত্র শুভ শঙ্করের অসুস্থতার জের ধরে সংসারে শুরু হয় নানা অশান্তি। একসময় সেতার বাজানো ছেড়ে দেন অন্নপূর্ণা দেবী। কিন্তু নৃত্যশিল্পী কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে রবিশঙ্করের প্রণয়ের কথা জানতে পেরে মাইহারে চলে যান তিনি। সমাপ্তি ঘটে তাঁদের সংসারের।
তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদের পর রবিশঙ্কর বিয়ে করেন অ্যামেরিকান কনসার্ট উদ্যোক্তা স্যু জোন্সকে। তাঁদের ঘরে জন্ম হয় আজকের বিখ্যাত পপ, জ্যাজ, পাশ্চাত্য লোকসংগীত শিল্পী ও সুরকার নোরা জোন্সের। এ বিয়েও না টিকলে আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বয়সে বেশ ছোট সুকন্যা কৈতানের সাথে। তাঁদের ঘরে জন্ম হয় বিখ্যাত সেতারবাদক আনুশকা শঙ্করের।
রবিশঙ্করের সঙ্গীত জীবন
ওস্তাদের সাহচর্যে থেকে সঙ্গীতযন্ত্র ও ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের উপর পান্ডিত্য অর্জন করার পর ১৯৪৪ সালে মুম্বাই চলে আসেন রবিশঙ্কর। সেখানে তিনি যুক্ত হন ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সাথে। এক বছর পর কবি ইকবালের সারে জাঁহা মে আচ্ছা কবিতায় সুর দিয়ে সুনাম অর্জন করেন। তারপর ১৯৪৯ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওর নয়াদিল্লি শাখায় সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করার আহ্বান পান এবং ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সেখানে কাজ করেন। ১৯৫০ সালের দিকে সিনেমার আবহ সঙ্গীতে কাজ শুরু করেন। বেশ কিছু হিন্দি সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি সত্যজিৎ রায়ের অপু-ত্রয়ীর (পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার) মতো বিখ্যাত সিনেমারও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে একক সেতার পরিবেশনের সুযোগ পান তিনি। এরপর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পারফর্ম করতে শুরু করেন এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তাও অর্জন করেন। মূলত এর মাধ্যমেই পণ্ডিত রবিশঙ্কর বিশ্বের কাছে ভারতীয় রাগ সঙ্গীত তুলে ধরতে সক্ষম হন। ১৯৫৬ সালে তার রাগ সঙ্গীতের উপর তিনটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮ সালে ইউনেস্কো সঙ্গীত উৎসবে পারফর্ম করেন তিনি। আর ঐ বছরেই প্রতিষ্ঠা করেন কিন্নর স্কুল অফ মিউজিক। যার প্রতিষ্ঠাকালীন মুম্বাই শাখা ছাড়াও বর্তমানে লস এঞ্জেলস এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় দুটি শাখা রয়েছে। ১৯৬৭ সালে তিনি দ্য মনেটারি পপ ফেস্টিভ্যালে সেতার পরিবেশন করেন এবং মেনহুইনের সাথে জার্মানির বেস্ট চেম্বার মিউজিক পারফর্মেন্স ফর ওয়েস্ট মিটস ইস্ট পুরষ্কারে ভূষিত হন। ১৯৭১ সালে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজন করেন এবং সেখানে সেতার পরিবেশন করে বাঙালীদের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করেন। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে সঙ্গীত জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৮৯ সালে নৃত্যনাট্য ঘনশ্যামের মাধ্যমে আবার কাজে ফিরে আসেন। কিন্তু ১৯৯২ সালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থায়ী বিরতিতে চলে যান।
পুরস্কার ও সম্মাননা
পন্ডিত রবিশঙ্কর তার সঙ্গীত জীবনে অর্জন করেছেন চারটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড যার মধ্যে সর্বশেষ অ্যাওয়ার্ড তার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও পেয়েছেন নানা পুরস্কার। অর্জন করেছেন বিশ্বখ্যাত নানা সম্মাননাও। চলুন এক নজরে দেখে আসা যাক কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা
- ১৯৬২ সাল – ভারতীয় শিল্পের সর্বোচ্চ সম্মাননা ভারতের রাষ্ট্রপতি পদক
- ১৯৮১ সাল – ভারতের সর্বোচ্চ সুশীল সমাজ পুরস্কার পদ্মভূষণ পদক
- ১৯৯১ সাল – ফুকোদা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজেসের গ্র্যান্ড প্রাইজ
- ১৯৯৮ সাল – সুইডেনের পোলার মিউজিক প্রাইজ
- ১৯৯৯ সাল – ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ভারতরত্ন পদক
- ২০০০ সাল – ফরাসি সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান অ্যাওয়ার্ড লিজিয়ন অব অনার
- ২০০১ সাল – রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কর্তৃক প্রদত্ত নাইট কমান্ডার
- ২০০২ সাল – দুটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড
- ২০০৩ সাল – আইএসপি এ ডিস্টিংগুইশ্ড আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড, লন্ডন
- বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত দেশিকোত্তম
রবিশঙ্করের কাছে সঙ্গীত ছিল প্রার্থনার মতো। তিনি বলতেন,
music is the only thing that keeps me going.
বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগে, বেশ কয়েকবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় দূর্বল হয়ে যান রবিশঙ্কর। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা তীব্র হলে হৃৎপিণ্ডের ভাল্ব পরিবর্তনের জন্য অপারেশন করা হলেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি তাঁকে। ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর ৯২ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়াগোর স্ক্রিপস মেমোরিয়াল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন বিখ্যাত পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
দৈহিকভাবে পণ্ডিত রবিশঙ্কর আমাদের মাঝে আর নেই। কিন্তু তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি আর সেতারের সুরে তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি আছেন- থাকবেন চিরকাল। তার অনুসারীরা শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ করবে আজীবন।