বিদেশী এক সুপুরুষ যখন বাঙ্গালী পোশাকে বাংলা ভাষায় কবিগান পরিবেশন করেন তখন তা নিতান্তই অভাবনীয় বিষয়, উনিশ শতকের সেই সময়ে। পিতার কর্মসূত্রে পর্তুগাল থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আগমন কবিয়াল এন্টনি ফিরিঙ্গীর। আসল নাম হ্যান্সম্যান এন্টনি (Hensman Anthony)। তাঁর জন্মসাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে লোকমুখে শোনা যায় তিনি ১৭৮৬ সালে পর্তুগালে জন্মগ্রহণ করেন। পর্তুগাল হতে আগত বলে তাঁর নামের শেষে যুক্ত হয়েছিল ‘ফিরিঙ্গী’ শব্দটি। পশ্চিমবঙ্গে আসার পর ফরাসডাঙ্গা নামক এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী হয়েও পশ্চিমবঙ্গে আসার পর হিন্দু ধর্মের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ জন্মে। পিতার ব্যবসার দিকে মন না দিয়ে বাংলার সংষ্কৃতিকে ভালোবেসে কবিগানের পথই বেছে নেন এই এন্টনি ফিরিঙ্গী।
কবিগান বলতে আমরা সাধারণত বুঝি লোকসংগীতের প্রতিযোগিতামূলক গানের আসর যেখানে মুখে মুখে কবি নামক গায়করা গানের পদ রচনা করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাতে সুরারোপ করেন। কবিগানকে সেকালে ‘কবির লড়াই’ও বলা হতো। তৎকালীন এই কবির লড়াই সংস্কৃতি ও বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল এবং তা দেখতে শত শত মানুষের ভীড় হতো। পশ্চিমবঙ্গে আগমনের পর এন্টনি ফিরিঙ্গীকে যা প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল তা হলো এই কবিগান। কবিগান চর্চা করার জন্যই তিনি একটি দল গঠন করেছিলেন। প্রথম প্রথম তিনি গান লিখার জন্যে গোরক্ষনাথের সাহায্য নিয়েছিলেন, পরে তিনি নিজেই গান বাঁধতে সক্ষম হন। তৎকালীন বিখ্যাত কবিয়াল হরু ঠাকুর, ভোলা ময়রা, দশরথি রায়দের সাথে তিনি কবিগানে অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন সময়ে কবিগানের লড়াইয়ে তিনি এ সকল বিখ্যাত কবিয়ালদের পরাজিত করেন।
হিন্দুধর্মের প্রতি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি তাঁর এক কবিগানে উল্লেখ করেছিলেন ‘আমি ভজন সাধন জানি নে মা/ নিজে ত ফিরিঙ্গী, যদি দয়া করে কৃপা কর/ হে শিবে মাতঙ্গী’। তাঁর আগমনী পর্যায়ের গান ‘জয় যোগেন্দ্রজায়া মহামায়া মহিমা অসীম তোমার’ এর মাধ্যমে তাঁর হিন্দুধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়াও তাঁর রচিত অনেক কবিগানেই অসাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়া পাওয়া গিয়েছিল। জাতি, ধর্ম ও বর্ণভেদে সকল মানুষেই যে এক তা তিনি তাঁর কবিগানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। কবিগানে তাঁর এমন অসাধারণ পান্ডিত্য সেকালে সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। উনিশ শতকের বিখ্যাত কবিয়ালদের সাথে কবির লড়াইয়ে তিনি অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
হিন্দু ধর্মের প্রতি তাঁর দুর্বলতা থাকলেও হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারকে কখনোই প্রশ্রয় দেননি এন্টনি ফিরিঙ্গী। সৌদামিনি নামক এক ব্রাহ্মণ বিধবাকে সতীদাহ থেকে রক্ষা করে পরবর্তী সময়ে বিয়ে করেছিলেন তিনি। কিন্তু তৎকালীন সমাজ সেই বিয়ের বিরোধিতা করেছিল যার ফলস্বরুপ সৌদামিনিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। তিনি কলকাতার বউবাজার এলাকায় ‘ফিরিঙ্গী কালীবাড়ি’ নামে একটি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইউরোপিয়ান হয়েও এন্টনির এই দেশের মাটি, সমাজ, সংস্কৃতি, গান এসবের প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা। বিদেশী হয়েও বাংলার সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার এই নিদর্শন আজও ইতিহাসে বিরল। উনিশ শতকের পর বাংলার সংস্কৃতির অধ্যায়ে আর কোনো ইউরোপিয়ানের পদচারণার ঘটনা তেমন দেখা যায়নি। ১৮৩৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৬৭ সালে তাঁর জীবনী নিয়ে নির্মিত হয় উত্তম কুমার অভিনীত চলচ্চিত্র ‘এন্টনি ফিরিঙ্গী’ এবং ২০১৪ সালে নির্মিত হয় প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘জাতিস্বর’। বাংলার সংস্কৃতির ধারায় শুধু কবিগানের জন্যই নয়, বাংলা ভাষা আয়ত্ব এবং বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য বিখ্যাত মানুষদের মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত এই বিদেশী এন্টনি ফিরিঙ্গী। যুগে যুগে কালের বিস্তৃতিতে হারিয়ে যাচ্ছে সংস্কৃতি পর্যায়ের সেসব মানুষ যারা এই সংস্কৃতির অবগাঠামো তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁদেরই একজন এন্টনি ফিরিঙ্গী। সংস্কৃতিকে ভালোবাসার এমন ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই তা এক আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখাবে পরবর্তী প্রজন্মকে।
Author: Umme Saima
Student, Dept. of Statistics
Noakhali Science and Technology University
- Review: Prosenjit Chatterjee’s ‘Jaatishwar’ is a nostalgic tribute to 19th century Bengal, but falls short as a biopic. India: News18, 2014.
- Bandopadhay, Madan. Kabiyal Anthony Firingee. 1964.