১৯৭১ সালে সংকটকালীন সময়ে যে সকল বিশ্ব ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাদের মাঝে জোয়ান বায়েজ অন্যতম। “স্টোরি অব বাংলাদেশ” নামে গান রচনার মধ্য দিয়ে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো অত্যাচার-নিপীড়নের চিত্র ফুটিয়ে তোলেন বিশ্ববাসীর সামনে। শুধু বাংলাদেশের জন্যেই নয়, যেকোনো সময় যেকোনো দেশে মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েছেন তিনি- কখনোবা তা নিজ দেশের বিপক্ষে গিয়েও।
১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জন্ম নেয়া জোয়ান বায়েজ একাধারে ছিলেন লোকজ সংগীতশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও সমাজকর্মী। ১৯৫৯ সালে “লোকসংগীত উৎসবে” গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৬০ সালে তার প্রথম গানের অ্যালবাম “জোয়ান বায়েজ” প্রকাশিত হয়। এরপর পরই প্রকাশিত হয় “জোয়ান বায়েজ ভলিউম ২” ও “জোয়ান বায়েজ ইন কনসার্ট”। তিনটি অ্যালবামই বিভিন্ন চার্টে টানা দুই বছর স্থান ধরে রেখে গোল্ড রেকর্ডের মর্যাদা পায়। ইংলিশ ও স্প্যানিশ ভাষায় সমানভাবে পারদর্শী জোয়ান বায়েজ এ দুটি ভাষার পাশাপাশি গান রেকর্ডিং করেছেন অন্তত আরো ছয়টি ভাষায়। প্রায় ৫৭ বছরের সংগীত জীবনে ৩০টি গানের অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন তিনি। পরিস্কার কন্ঠ, লম্বা চুল ও প্রকৃতিপ্রদত্ত সৌন্দর্যই জোয়ানের ডাকনাম ম্যাডোনাকে সে সময় অত্যধিক পরিচিত করার অন্যতম কারণ ছিল।

সংগীত জোয়ান বায়েজের প্রধান পরিচিতি হলেও সমাজকর্মী হিসেবে তার কাজ দেখা হলে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে গানকে তিনি করেছেন তার প্রতিবাদের হাতিয়ার। তৎকালীন লোকপ্রিয় সংগীতে বায়েজের বৈচিত্র্যময় কন্ঠ ও রাজনৈতিক সক্রিয়তার ব্যাপক প্রভাব ছিল। বলা হয়ে থাকে শিল্পীদের মাঝে জোয়ানই নিজের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে প্রথম গানকে ব্যবহার করেছেন প্রতিবাদের ভাষা, মানবাধিকার রক্ষা ও শান্তির বার্তা প্রেরনের মাধ্যম হিসেবে।
প্রথম জীবন থেকেই জোয়ান ছিলেন প্রতিবাদী। ১৯৫৮ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আল্টো উচ্চ বিদ্যালয়ে অসামরিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্যে স্কুল ত্যাগে অস্বীকৃতি জানিয়ে জোয়ান প্রথম আইন অমান্য করেন। সংগীত জীবনের প্রথম থেকেই জোয়ান মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। পিট সীগার ও গাই কারওয়ানের লেখা “উই শ্যাল ওভারকাম” গানটি ১৯৬৩ সালে চাকরী ও স্বাধীনতার জন্যে ওয়াশিংটন অভিমুখে হাঁটার সময় গাওয়ার মাধ্যমে জোয়ান ঐতিহাসিকভাবে এ গানের সাথে যুক্ত হন।
১৯৬৭ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পক্ষে কথা বলে দুবার গ্রেপ্তার হন তিনি। এ সম্পর্কে জোয়ান বলেন “I went to jail for 11 days for disturbing the peace; I was trying to disturb the war.” এসময় সরকারকে কর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে রেভিনিউ সার্ভিসকে দেয়া চিঠিতে তিনি বলেন- “আমি যুদ্ধে বিশ্বাসী নই, আমি যুদ্ধের অস্ত্রে বিশ্বাসী নই, আমি আমার বছরের আয়করের ৬০% অস্ত্রের জন্য খরচ হতে দেবো না।” পরবর্তী সময় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি লেখেন “স্টোরি অব দ্য বাংলাদেশ” শীর্ষক গান যেখানে ২২ বার বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারণ করেন। এ গানের মাঝে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতা, গণহত্যা, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্ত্রহীন ছাত্রদের হত্যার কথা ফুটিয়ে তোলেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে চান্দস মিউজিক থেকে প্রকাশিত “কাম ফ্রম দ্য শ্যাডোস” অ্যালবামে “দ্য সং অব বাংলাদেশ” নামে গানটি সংযুক্ত করেন। তবে অজ্ঞাত কোন কারণে বাংলাদেশকে আর্থিকভাবে সহযোগিতার জন্যে করা কনসার্ট ফর বাংলাদেশে তিনি ছিলেন না। ১৯৮৭ সালে তিনি মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে গান করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি রিফিউজি ইন্টারন্যাশনালের আহ্বানে সোরোস ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে বসনিয়া ও হারজেগোভিনা সফর করেন। গৃহযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত যুগোস্লোভিয়ায় অন্যতম প্রধান শিল্পী হিসেবে জোয়ানই প্রথম গান করেন। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানিয়ে একটি এবং ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের অবসান চেয়ে সানফ্রান্সিকোতে দুইটি কনসার্ট করেন জোয়ান। ২০০৫ সালের আগস্টে টেক্সাসে সিন্ডি শিহানের শুরু করা যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনেও যোগ দেন তিনি।

শুধু যুদ্ধই নয়, রাজনৈতিক আন্দোলন ও সমকামীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনেও জোয়ান ছিলেন সমানভাবে সক্রিয়। ১৯৮৯ সালে চীনের তিয়েনমান স্কয়ারে গণতন্ত্রের জন্যে করা ছাত্র আন্দোলনে সরকারী বাহিনীর আক্রমনে হাজারো শিক্ষার্থীর প্রাণ হারানোর ঘটনাকে গণহত্যা উল্লেখ করে চীনের কমিউনিস্ট দলের নিন্দা করে তিনি “চায়না” নামক একটি গান রচনা করেন। এছাড়াও ১৯৭৮ ক্যালিফোর্নিয়াতে কোনো সমকামী শিক্ষক স্কুলে পড়াতে পারবে না বলে যে ব্রিগস উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তাকে পরাজিত করার জন্যে একাধিক কনসার্ট করেন তিনি।
১৯৫৬ সালে জোয়ান সর্বপ্রথম মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের কথা শোনেন এবং অহিংসতা, মানবাধিকার রক্ষা ও সামাজিক পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে আসা মার্টিনের কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। এর কয়েক বছর পর বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত হওয়ার মাধ্যমে তাদের দুজনের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গঠনে অবদান রাখেন জোয়ান বায়েজ এবং সহযোগিতার জন্যে বরাবরই এর পাশে ছিলেন তিনি। আমেরিকান মাস্টার্স নামক পিবিএস সিরিজের করা সংগীত ও সমাজসেবা এ দুয়ের মাঝে কোনটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- সমাজ সেবাই তার জীবনের ব্রত, গানের থেকে এটা বড়।