১৯৬৫ সালে লন্ডনের রাস্তায় হাঁটতে গেলে হয়তো মাঝে মাঝে দেয়ালের একটা চিকা আপনার চোখে পড়তো-
“ক্লাপ্টন-ই ঈশ্বর”
ব্যাপারটাকে ধর্মীয় বিপ্লব ভেবে ভুল করবেন না, এটা বিখ্যাত রক আর্টিস্ট এরিক প্যট্রিক ক্লাপ্টন এর রক জগতে যাত্রার গল্প। ক্লাপ্টন এর জন্মস্থান যদিও ইংল্যান্ডে, ছোট থেকেই তার আমেরিকান ব্লুজের প্রতি একটা ঝোঁক ছিল। ব্যাপারটা ভাগ্যও বলা যায়। সে চেয়েছিলেন আমেরিকান ব্লুজকে আরাধনা করতে কিন্তু নিজেই ভজনের বিষয় হয়ে আছেন আজ আমাদের কাছে।
এরিক ক্লাপ্টন ১৯৪৫ সালের ৩০ মার্চ ইংল্যান্ডের সুরি শহরে জন্ম নেন। গিটারের সুরে তার হাত পরে ১৯৫৮ সালে। ব্যান্ড জগতে তার সূচনা হয় ইয়ার্ডবার্ড ব্যান্ডের সাথে, যেখানে গিটারিস্ট হিসেবে আরও ছিলেন লেড জেপলিনের গিটারিস্ট জিমি পেজ। ইয়ার্ডবার্ড অল্প সময়েই অনেক সুনাম কুঁড়াতে থাকে কিন্তু সমস্যা দেখা যায় অ্যালবাম করতে গিয়ে। ব্যান্ডটি অনেকটাই পপ জনরার দিকে ঝুঁকে পড়ে যেখানে গান বাজারজাত করাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ক্লাপ্টনের আত্মা জুড়ে অকৃত্রিমতার ব্যাপারটি ছিল। এজন্য সে ইয়ার্ডবার্ডে নিজেকে আর খাপ খাওয়াতে পারেননি। এরপরে জন মায়ালের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁর সাথে ১৯৬৬ সালে ‘ব্লুজ ব্রেকারস উইথ এরিক ক্লাপ্টন’ নামে অ্যালবাম বাজারে ছাড়েন। এই ব্যান্ডেও তাঁর বেশিদিন মন টিকেনি। আধিপত্য নিয়ে ব্যান্ডটায় ঝামেলা হতে থাকে, কারণ জন মায়াল সবসময় কর্তৃত্ব ফলাতে চান। ক্লাপ্টনকে আবার ব্যান্ড ছাড়তে বাধ্য করে তাঁর অবচেতন মন।
ক্লাপ্টনের পরের যাত্রায় অংশ নিতে হলে আপনাদেরকে তৎকালীন ‘সাইকেডেলিক সমাজ’ এবং ‘উত্তর-আধুনিকতা’ সম্পর্কে জানতে হবে। উত্তর-আধুনিকতার (post modernism) সময় শুরু হয় ১৯৩৯ সাল থেকে। উত্তর-আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য ভেবে দেখলে আমরা সেগুলার সাথে ক্লাপ্টনের মিউজিকাল স্টাইলের ভাবটা বুঝতে পারব। প্রথমত, উত্তর-আধুনিকতা একটি আমেরিকা-ঘটমান বিষয়, যেটা পাল্টা সংস্কৃতিকে (counter culture) কেন্দ্র করে বেড়ে উঠেছে। বাণিজ্যিকীকরনের তীব্রতা এবং যুদ্ধউত্তরের পর নতুন এক সমাজ তৈরি হয়। মূলত সেটা শুরু হয় ফ্রান্সে কিন্তু এর তীব্রতা দেখা যায় আমেরিকাতে। হিপি (hippy) কালচার নামে নতুন এক উপ-সংস্কৃতি হয়, যেখান থেকে উঠে আসে বিটেলস, বব ডিলান এর মত আর্টিস্ট, ক্লাপ্টনও তাদের একজন। এটা ছিল বহেমিয়ান সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যেখানে সবাই প্রথানুগতা, প্রচলিত শাস্ত্রবিধির উপরে অন্ধবিশ্বাসের এবং বস্তুবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। এটা ছিল আমিরিকান প্রথাগত জীবনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। তারা পিউরিটানিজম (puritanism), রক্ষণশীলতা এবং স্বৈরাচারীতাকে ঘৃণা করত। সেখান থেকেই তাদের মুক্ত যৌনমিলন এবং অবাধ মাদকের ব্যবহারের সূত্রপাত ঘটে। মূলত সাইকেডেলিক সংস্কৃতির শুরু এটাই। মিউজিশিয়ানরা মাদকাসক্ত অবস্থায় তাদের পরীক্ষামূলক রচনাতে হাত দেয়। ক্লাপ্টন এই পাল্টা সংস্কৃতিকে আমন্ত্রণ জানায় এবং তার পরবর্তী সংগীত ক্যারিয়ারে আমরা সেটার প্রভাব দেখতে পাই। জ্যাক ব্রুস ও জিঞ্জার বেকারের সাথে তার আদর্শ কোনভাবে মিলে যায়। তারা একসাথে রক, ব্লুজ এবং জ্যাজের দেয়াল ভেঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন এক স্টাইলের সুচনা করেন। ব্যান্ডের নাম হয় ‘ক্রিম’ এবং জনরার নাম সাকেডেলিক পপ। শুধু সুরেই না, লিরিকেও আসে পরিবর্তন। এক কথায় বলা যায়, গানের যে প্রথাগত মৌলিকতা ছিল, সেটার বাইরে নতুন এক স্টাইল এটা। একসময় এই ব্যান্ডের সময় শেষ হয়ে আসে। কারণ ব্যান্ডটি হওয়ার পূর্ব থেকেই বেকার এবং ব্রুস পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না, পরস্পরকে ঘৃণা করতেন তারা। আর ব্যান্ডটি সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য আসতে থাকে তাদের পুনরাবৃত্তিক গানের রচনার জন্য। ক্লাপ্টন ব্যাপারটিতে সায় দেয়। এই কারণগুলো অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়াতে অবশেষে ১৯৬৮ সালে তারা ব্যান্ডটির সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
১৯৬৯ সালে ক্লাপ্টন এবং বেকার মিলে নতুন গ্রুপ খুলে, নাম দেয় ‘ব্লাইন্ড ফেইথ’। সেখানে কিবোর্ড এবং ভোকাল হিসেবে যোগ দেয় স্টিভ উইনউড, বেজ গিটারে আসেন রিক গ্রেচ। সেটাও টিকে মাত্র এক বছর।
এরপরে ক্লাপ্টন তাঁর একক ক্যারিয়ার সম্পর্কে ভাবা শুরু করেন। ১৯৭০ সালে তাঁর কন্ঠে গাওয়া এক অ্যালবাম রচনা করেন। তার সাথে যোগ দেয় বেজ গিটারিস্ট কার্ল রেডলে, ড্রামার জিম গরডোন এবং কীবোর্ডিস্ট ববি হুইটলক। শুরু হয় ‘ডেরেক অ্যান্ড দ্যা ডমিনস’ এর যাত্রা। ক্লাপ্টন ব্যান্ডটির লিড গিটারিস্ট, ভোকালিস্ট এবং লিরিসিস্ট। তাদের ‘লেইলা অ্যান্ড আদার অ্যাসোর্টেড লাভ সং’ অ্যালবামটি মাস্টারপিস হিসেবে গানের জগতে স্থান করে নেয়। কিন্তু তাৎক্ষণিক কম বিক্রি হওয়ায় এবং তার অতিরিক্ত হিরোইন আসক্তির কারণে ক্লাপ্টন গানের জগত থেকে দুই বছর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
১৯৭৪ সালে তার গানের জগতে পুনরায় প্রবেশ ঘটে আরেকটি মাস্টারপিস ‘৪৬১ ওসেন বুলেভার্ড’ অ্যালবামের মাধ্যমে। এই অ্যালবামে ক্লাপ্টন তার গিটার বাজানো থেকে ভোকাল এবং লিরিকের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেন।
- Barclay, Shelly. “Five Things You Didn’t Know about Cream.” AXS, 29 Mar. 2015, www.axs.com/five-things-you-didn-t-know-about-cream-46629.
- Brown, Randy. “Postmodernism and Music.” YouthWorker, 20 Oct. 2011, www.youthworker.com/articles/postmodernism-and-music/.
- “For People Who Appreciate Great Music.” Music Aficionado, web.musicaficionado.com/main.html#!/video/PIuRLBrE5N