গৌতম চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর ভাই প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়সহ আরো পাঁচজন তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষাল, তাপস দাস, এব্রাহাম মজুমদার, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় মিলে তৈরি করলেন একটি নামহীন গানের দল। সাতজন থেকে সপ্তর্ষি নামে চলতে থাকে দলটি। মাঝে মাঝে মিউজিকাল শো গুলোতে নিজেদের গৌতম চ্যাটার্জি বিএসসি অ্যান্ড সম্প্রদায় বলে পরিচয় দেন। এভাবে ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলছে, এর মাঝে মহীনের ঘোড়াগুলি’র একজন সদস্য রঞ্জন ঘোষাল, জীবনানন্দ দাশের ‘ঘোড়া’ কবিতাটির লাইনগুলো আবৃতি করে শোনালেন সবাইকে –
আমরা যাইনি মরে আজো– তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়ঃ
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে…
১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮১ সালের মাঝে মহীনের ঘোড়াগুলি দর্শকদের তিনটি অ্যালবাম উপহার দিয়েছে। সেগুলো হল-
- সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক (১৯৭৭)
- অজানা উড়ন্ত বস্তু ও অ-উ-ব (১৯৭৮)
- দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি (১৯৭৯)
এই তিনটি অ্যালবামে সর্বমোট আটটি গান আছে।
ব্যান্ড ভাঙ্গার পর চারটি সম্পাদিত অ্যালবামের কাজ হয়। অ্যালবামগুলো হল-
- আবার বছর কুড়ি পরে (১৯৯৫)
- ঝরা সময়ের গান (১৯৯৬)
- মায়া (১৯৯৭)
- ক্ষ্যাপার গান (১৯৯৯)
ব্যান্ডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। শুরুর দিকে ব্যান্ড তথাকথিত জনপ্রিয়তা পায়নি। পরবর্তী সময়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে নব্বইের দশকে বিপুল জনপ্রিয়তা পায় ব্যান্ডটি। যার মূল কারণ ছিল গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট আর সংগীতের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র খুঁজে বের করা। নব্বইের দশকে বিশ্বায়নের পর নগরকেন্দ্রিক এবং যান্ত্রিকতায় আবর্তিত হতে থাকে আমাদের জীবন যা আমরা তাঁর লিখা ‘পৃথিবীটা নাকি’ শিরোনামের গানে পাই। এটি আজও সর্বাধিক জনপ্রিয়।
পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে
স্যাটালাইট আর কেবলের হাতে
ড্রইংরুমে রাখা বোকা-বাক্সতে বন্দি
আহা-হা-হা আহা আহা-হা-হা
আহা আহা-হা-হা………..
ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে
যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে
ঘুঁচে গেছে দেশ-কাল-সীমানার গন্ডি
আহা-হা-হা আহা আহা-হা-হা
আহা আহা-হা-হা………..
সত্তরের দশকে পশ্চিমা রক এবং সাইকেডেলিক কালচারে উৎসাহিত হয়ে কলকাতা তথা ভারতেও অনেক সাইকেডেলিক রক ব্যান্ডের জন্ম হয়। সেসময় খোদ কলকাতাতেই অনেক রক ব্যান্ডের জন্ম হয়। কিন্তু এই ব্যান্ডগুলোর সাথে মহীনের ঘোড়াগুলির মূল পার্থক্য ছিল যে এই ব্যান্ডগুলোর শ্রোতা ছিল হাতেগোনা এলিট শ্রেনী। কারণ এরা গান করত ইংরেজীতে, আর এরা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলন আর নকশাল আন্দোলনের মাঝের প্রজন্ম। তাই কোন সংগ্রাম বা আন্দোলন না দেখে নিজেদের তৈরি কল্পনার ভেতর নিয়ে বসে ছিল তারা। এখানেই মহীনের ঘোড়াগুলির সার্থকতা। গৌতম এইটা ভালভাবেই বিশ্বাস করতেন যে বাংলা গান ছাড়া কলকাতার সাধারন মানুষ গান শুনবে না। আর নকশাল আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারনে তার লিরিক্স গড়ে ওঠে নিজের জীবনে দেখা অভিজ্ঞতা থেকে। বাংলায় রক, ব্লুজ আর জ্যাজ ধারার গানকে সাধারনের মাঝে নিয়ে যান। সেসময়ের তাদের চিন্তা চেতনা দেখলে আজও অবাক হতে হয় তারা কতটা যুগের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। এজন্য আজও ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডটি বটবৃক্ষের মতো। বাংলা রক মিউজিশিয়ানরা চলার পথে যার ছায়ায় বসে ক্লান্তি দূর করে, অনুপ্রেরণা নিয়ে আবার পথচলা শুরু করে।