কিছু ব্যক্তিত্ব সংস্কৃতির সাথে যুক্ত থেকে সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যান আর কিছু ব্যক্তিত্ব তথাকথিত ধারাবাহিকতার থেকে বেড়িয়ে সূচনা করেন সংস্কৃতির নতুন ধারা। আজম খান তাদেরই একজন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের হতাশাগ্রস্থ তরুণ সমাজকে অন্ধকার থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টায় শুরু করেন গান। দেশের প্রচলিত সংগীত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী গানে শুরু করা এ যাত্রায় বাংলা পপ সংগীতের সূচনা করেন তিনি। মাহবুবুল হক খান থেকে তিনি হয়ে ওঠেন সকলের প্রিয় আজম খান।
একাধারে সুরকার, গীতিকার ও শিল্পী আজম খানের সংগীতের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও গানের সাথে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাওয়া সদ্য স্বাধীন দেশের হতাশাগ্রস্থ তরুণদের জন্যে কিছু করার আকাঙ্ক্ষা থেকেই শুরু করেন গান। তিনি পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্রের সাথে বাংলা গানের মিশ্রণে দেশে গড়ে তোলেন গানের এক নতুন ধারা। সাধারণ মানুষের জীবনের বাস্তবতাকে ঘিরে গাওয়া গানের কথার সাথে সহজ ও জমকালো সু্রের গান স্থান করে নেয় লাখো মানুষের অন্তরে।
মুক্তিযুদ্ধ ও আজম খান
১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেয়া ডানপিটে ও সাহসী আজম খান ’৭১এর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধে যাবার আগে অনুমতির জন্য গেলে বাবা বলেন “যুদ্ধে যাবি যা, দেশ স্বাধীন না করে ঘরে ফিরবি না।” এরপর দুই বন্ধুর সাথে পায়ে হেঁটে চলে যান আগরতলা। ভারতের মেলাঘরের শিবিরে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য কিছুদিন পর দুই নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল খালেদ মোশাররফের অধীনে একটি সেকশনের ইন-চার্জ করে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। সেকশান কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন তিনি। আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ি-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘অপারেশান তিতাস’। অপারেশনটির লক্ষ্য ছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও হোটেল পূর্বাণীসহ ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করার মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো যাতে করে ঐ সকল হোটেলে অবস্থানরত বিদেশীরা দেশে চলমান যুদ্ধের কথা বুঝতে পারেন। এ যুদ্ধে তিনি তাঁর বাম কানে আঘাতপ্রাপ্ত হন যা পরবর্তী সময়ে তাঁর শ্রবণক্ষমতায় বিঘ্ন ঘটায়। আজম খান তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এর আগে তাঁরা মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে সংগঠিত যুদ্ধে পাক সেনাদের পরাজিত করেন। তিনি শুধু অস্ত্র হাতে যুদ্ধই করেননি, গান গেয়ে প্রশিক্ষণ শিবিরে সহযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণাও যুগিয়েছেন সমানভাবে। আজম খানের স্মৃতিকথা উল্লেখ করে ‘একাত্তরের দিনগুলি’গ্রন্থে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লিখেন, “২০শে আগস্ট, ১৯৭১ একটা তাঁবুতে আলো জ্বলছে, আর সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর: হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ- বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।”
নতুন এক যুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও শেষ হয়নি যুদ্ধ। বরং বলা যায় নয় মাসের দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে বেকার ও হতাশাগ্রস্থ তরুণসমাজকে দুর্নীতি আর অপরাধ জগৎ থেকে দূরে রেখে আশার আলো দেখানোই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর সে চ্যালেঞ্জই গ্রহণ করলেন তরুণ আজম খান। স্পন্দনের পর বাংলা নামে স্বাধীন দেশের দ্বিতীয় ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’ দিয়ে শুরু করা এ যাত্রায় পাশে পেলেন ‘আখন্দ’ভাতৃদ্বয়- হ্যাপি আখন্দ এবং লাকী আখন্দকে। গিটারে থাকলেন আজম খানের বন্ধু নিলু আর মনসুর, ড্রামসে সাদেক আর নিজে রইলেন প্রধান ভোকালিস্ট হিসেবে। ১৯৭২ সালে বিটিভির ডাকে
এতো সুন্দর দুনিয়ায়
কিছুই রবে না গো
হে আল্লাহ, হে আল্লাহ রে
একক
১৯৮২ সালে ‘এক যুগ’নামের এ্যালবাম দিয়ে অডিও জগতে আত্মপ্রকাশ করেন আজম খান। এরপর থেকে নিয়মিত বিরতিতে মোট ১৭টি একক এ্যালবাম করেন। তার প্রথম সিডি বের হয় ১৯৯৯ সালের ৩ মে ডিস্কো রেকর্ডিংয়ের প্রযোজনায়। ডুয়েট এবং মিক্সডসহ তার অ্যালবাম সংখ্যা ২৫। তার উল্লেখযোগ্য এ্যালবামগুলোর মধ্যে আছে দিদি মা, বাংলাদেশ, কেউ নাই আমার, অনামিকা, কিছু চাওয়া, নীল নয়না ইত্যাদি। এছাড়া তিনি অনেক সিনেমাতেও গান করেছেন।
ব্যক্তি জীবন
১৯৮১ সালে ঢাকার সাহেদা বেগমকে বিয়ে করার পর তাদের ঘরে আসে এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। সহধর্মিণী মারা যাবার পর থেকে অনেকটা নিভৃতে অনাড়ম্বর একাকি জীবন যাপন করে গেছেন আজম খান। একটা সময় গান থেকেও অনেক দূরে সরে যান। হুট করেই যেন সবকিছু ছেড়েছুড়ে আড়ালে চলে যান আজম খান। হয়তো সুরের বাণিজ্যিকরণে নিজেকে কখনো বিকোতে চাননি তিনি। সে আক্ষেপ তার সাক্ষাৎকারেও স্পষ্ট। তার মতে, সুরের বানিজ্যিকীকরণের দরুন এখনের শিল্পীরা আর সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা বলছে না। সবারই ঝোঁক ‘স্টার’ হওয়ার দিকে। সবার ভেতরেই রাতারাতি গায়ক হতে চাওয়ার বাসনা, কিন্তু কেউ কাজ করতে আগ্রহী না। সবাই যেন লিফট বেয়ে ওপরে উঠতে চায়, সিঁড়ি চড়তে সবারই অবহেলা!
সংগীতের বাইরে গুরুর বিচরণ ও সম্মাননা
সংগীত ছাড়াও তিনি ১৯৮৬ সালে ‘হীরামন’ও ‘কালা বাউল’নামে একটি নাটকে কালা বাউলের চরিত্রে এবং ২০০৩ সালে ‘গডফাদার’নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় যার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এছাড়াও বিজ্ঞাপন জগতে তিনি পদার্পণ করেন ২০০৩ সালে ক্রাউন এনার্জি ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে বাংলালিংক ও কোবরা ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনেও কাজ করেন তিনি। গানের পাশাপাশি ক্রিকেটও খেলেছেন আজম খান। গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন। ফুটবলেও তিনি ছিলেন সমানভাবে পারদর্শী। তার বর্ণাঢ্য সংগীত জীবনে অনেকবার পুরস্কৃত হয়েছেন, যার মধ্যে হলিউড থেকে ডিসকো রেকর্ডিংয়ের সৌজন্যে ১৯৯৩ সালে ‘বেস্ট পপ সিংগার অ্যাওয়ার্ড’, Award of Council of Urban Guerilla, Dhaka 71 and Freedom Fighter Award from Radio Today ‘টেলিভিশন দর্শক পুরস্কার ২০০২’, ‘কোকাকোলা গোল্ড বটল’সহ ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ অন্যতম।
শেষদিনগুলো এবং অতঃপর
বছর খানেক ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে ২০১১ সালের ৫ জুন ৬১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন গুণী এ শিল্পী। এক সময় জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকা সত্ত্বেও যথেষ্ট অর্থকষ্টে জীবেনের শেষদিনগুলো কাটালেও কখনোই তা কাউকে বুঝতে দেননি। ৬৩তম জন্মদিনে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারিবারিক উদ্যোগে যাত্রা শুরু করা আজম খান ফাউন্ডেশন তার অবর্তমানে বিভিন্ন অ্যালবাম এবং মুঠোফোন প্রতিষ্ঠানের রিংটোনসহ অন্যান্য সেবা থেকে পাওয়া অর্থের একটা অংশ সমাজের অভাবে চিকিৎসা করাতে না পারা দুস্থ শিল্পীদের সহযোগিতা করার লক্ষ্য নিয়ে ফাউন্ডেশনের কাজে শুরু হলেও ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যপদ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা ও আর্থিক সংকটের কারণে এর সব কার্যক্রম ২০১৭ সালে মুলতবি করে তা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
পপসম্রাট, কিংবদন্তি, গুরু নামে খ্যাত আজম খান নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লিখে গেছেন ‘রেল লাইনের ঐ বস্তিতে’, ‘আলাল ও দুলাল’ এর মতো গানগুলো। সহজ জীবনযাপন আর সাবলীল ভাষার অধিকারী নিরহংকারী আজম খান কোন যন্ত্র বাজাতে না জেনেও একটি জাতিকে উপহার দিয়েছেন নতুন আঙ্গিকের গানের ধারা। বাংলা ব্যান্ডের বিকাশে আজম খানের প্রভাব নিয়ে কবীর সুমন বলেছিলেন- “দশ বারো বছর আজম খান ছিলেন বাংলাদেশের একচ্ছত্র রকসম্রাট। তারপর তিনি আর গান করেননি। কিন্তু আজও তিনি যদি গান করতে মঞ্চে উঠেন তো দর্শক ও ভক্ত সমাগম যা হবে তা দুই বাংলার অন্য কোন শিল্পীর ভাগ্যেই জুটবে না। তার অসংখ্য ভক্তের কাছে তিনি আজও গুরু।” খ্যাতি ও মোহের ঊর্ধ্বে থাকা এ মানুষটি বাংলাদেশের প্রথম রকস্টার এবং হাজারো তরুণের স্বপ্ন গড়ার কারিগর ও আদর্শ হিসেবে সবসময়ই বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।
Featured Image © Imtiaz Alam Beg
জানার ছিল✌