পুরো দুনিয়া না হলেও বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যান্ডে যারা ড্রামিং করেন বা যারা রক/মেটাল মিউজিক করেন বা শোনেন, আপনি যদি তাদের জিজ্ঞেস করেন যে “আপনার প্রিয় ড্রামার কে?” উত্তরে মোটামোটি ৮০ ভাগ লোক যে নামটি বলবে তা হল মাইক পর্টনয় (Mike Portnoy)। এর পেছনে একেকজন একেক কারণ বলবে, যুক্তি দেখাবে। কিন্তু সবাই যেখানে এসে মিলবে তা হল এই লোকটা রক ড্রামিং-এ নতুন মাত্রা দিয়েছেন। আজকের লিখাটা তাই মাইক পর্টনয়কে নিয়েই।

প্রগ্রেসিভ ড্রামিং (Progressive Drumming)

আপনারা যারা রক বা মেটাল ধারার গান শোনেন বা খোঁজ খবর রাখেন তাদের কাছে মাইক পর্টনয় নামটা শুনলেই মাথায় চলে আসে- প্রগ্রেসিভ রক, ড্রীম থিয়েটার ব্যান্ড কিংবা গানের অবিরাম তাল ভাঙ্গার ব্যাপারগুলো। আসলে পর্টনয় প্রগ্রেসিভ ড্রামিংকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে এই ধারার সাথে তার নামটা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এখানে প্রগ্রেসিভ ড্রামিং এর ব্যাপারে একটু বিস্তারিত বলা দরকার। প্রগ্রেসিভ ড্রামিং হল গানের সাথে ড্রামিং-এর প্রগ্রেসনটা পরিবর্তন করা। আসলে এ ধারাটাই এমন যে এ ধারার গানগুলোতে গিটার, ড্রামস, বেইসলাইন সবই ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়। দ্য ওয়াসিস (The Oasis), ড্রিম থিয়েটার (Dream Theater), রাশ (Rush), সিম্ফনি এক্স (Symphony X), টুলস (Tools), পিঙ্ক ফ্লয়েড (Pink Floyd), পরকুপাইন ট্রি (Porcupine Tree)- এই ব্যান্ডগুলোর গান শুনলেই বুঝতে পারবেন বিষয়গুলো কিভাবে বদল হয়। যাই হোক এবার আসি পর্টনয়ের কথায়।

বড় ড্রামকিট বরাবরই ছিল মাইক পর্টনয় এর পরিচয়
বড় ড্রামকিট বরাবরই ছিল মাইকের পরিচয়; Image source: Pinterest

প্রাথমিক জীবন

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জন্ম নেয়া মাইকের সংগীতের সাথে পরিচয় হয় অনেক অল্প বয়সে। তার বাবা স্থানীয় ডিজে (DJ) হওয়ার কারণে অনেক কম বয়সেই তার তার দ্য বিটেলস (The Beatles), লেড যেপ্পেলিন (Led Zeppelin), রাশ (Rush), দ্য হু (The Who)- ব্যান্ডগুলোর গানের সাথে পরিচয় ঘটে। তার বাবা মারা যাওয়ার পর তার বাবার সাথে শৈশবের স্মৃতিগুলো নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ড্রীম থিয়েটারেরদ্য বেস্ট অব টাইমস ’ গানটি। হাইস্কুলে থাকাকালীন তার দুইটি ব্যান্ড থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা ভেঙ্গে যায় এবং বৃত্তি পেয়ে তিনি বার্ক্লি কলেজ অব মিউজিকে চলে আসেন। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় প্রগ্রেসিভ মিউজিকের অপর দু’জন দিকপাল, জন পেট্রুচি (John Petrucci) ও জন মিয়াং (John Myung) এর সাথে। তবে পরবর্তী সময়ে তাঁরা একই সাথে কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বাদ দিয়ে ম্যাজেস্টি (Majesty) নামের ব্যান্ডটি গঠন করেন। এরপর থেকে মোটিভেশনাল স্পিচে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ড্রপ আউটের তালিকায় কিন্তু এই নামগুলো বলা হয়ে আসছে। পরে সময়ে এই ব্যান্ডটিই ড্রীম থিয়েটার হয়ে ওঠে এবং বের করতে থাকে একের পর এক হিট অ্যালবাম।

সৃষ্টিকর্ম

ইমেজেস অ্যান্ড ওয়ার্ডস (Images And Words), অক্টাভারিয়াম (Octavarium), চেঞ্জ অব সিজন্স (Change of Seasons), সিস্টেম্যাটিক ক্যাওয়াস (Systematic Chaos), ট্রেইন অব থটস (Train of Thoughts), মেট্রোপলিস পার্ট ওয়ান (Metropolis Pt.1) প্রত্যেকটা অ্যালবাম প্রগ্রেসিভ ধারাকে নতুন করে সংজ্ঞায়ন করেছে। আর মাইক পর্টনয় প্রত্যেকটা অ্যালবামেই যেন নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে গেছেন। প্রত্যেকটা অ্যালবামেই ড্রামিং এর ছিল বিচিত্রতা। তিনি নতুনভাবে ড্রামিংকে চিন্তা করতেন। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল অনেক গানেই তিনি ড্রামসে কিছু কিলার পার্টস (killer parts) রাখতেন। এ জন্য ড্রামাররা তার গান তোলার আগে এখনও কয়েকবার ভাবেন।

ড্রিম থিয়েটারে মাইক পর্টনয়
ড্রিম থিয়েটারে মাইক পর্টনয়; Image source: Alternative Revolt Magazine

তার সুন্দর ড্রামিং-এর গানতো আছে অনেক কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয় উনার সবচেয়ে কঠিন গান কোনটি? মোটামোটি ১০০ ভাগ ড্রামারই বলবে “দা ডান্স অব ইটারনিটি” (The Dance Of Eternity) গানটির কথা। একটি গানে কত রকমভাবে তাল ভাঙ্গা যায় আর কত রকমভাবে একই তালে বিভিন্ন বিষয় যোগ করা যায় তা এটা না শুনলে বোঝা যাবে না। তবে এটাই ছিল পর্টনয়ের ড্রীম থিয়েটারের অ্যালবামে বাজানো শেষ গান।

ড্রিম থিয়েটার থেকে বিদায় ও অন্যান্য ব্যান্ড

দীর্ঘ ২৫ বছর একসাথে বাজানোর পরে তিনি ২০১০ সালে সেপ্টেম্বর ৮ তারিখে ছেড়ে দেন। এরপরও তিনি অনেক ব্যান্ডেই বাজিয়েছেন যেমন দা উইনারি ডগস (The Winery Dogs), নিল মোর্স (Neal Morse), সান্স অব অ্যাপোলো (Sons Of Apollo), অ্যাড্রেনালিন মব (Adrenaline Mob)। কিন্তু কোন ব্যান্ডই তাকে ড্রীম থিয়েটারের মত সংজ্ঞায়িত করে না। মাইক পর্টনয় নামটা শুনলেই সবার আগে মনে আসে ড্রীম থিয়েটারের নাম আর ঐ ব্যান্ডের গানগুলো। এমনকি তিনি অ্যাভেঞ্জড সেভেনফোল্ড (Avenged Sevenfold) ব্যান্ডের নাইটমেয়ার (Nightmare) অ্যালবামটির কয়েকটা গানের ড্রামিং কম্পোজ করে দেন। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি ড্রামিং এর উপরে অনেক পুরষ্কার পেয়েছেন। সে ব্যাপারে আর এখানে না-ই বললাম।

প্রগ্রেসিভ ড্রামিং ও পর্টনয়

“আপনি মাইকের ড্রামিং খেয়াল করলেই বুঝবেন যে সেখানে যেমন নেইল পার্ট এর কম্বিনেসন ফিলস আছে ঠিক তেমনি বোনহ্যাম এর গ্রুভ আছে আবার কেইথ মুন এর শিফটিংও আছে।”

কিন্তু মাইক আসলে এমন কি করেছেন যার কারনে প্রগ্রেসিভ ধারার সাথে তার নামটি এভাবে জড়িয়ে গেছে? এরকম প্রগ্রেসিভ ধারার গান মাইকই প্রথম শুরু করেননি, তার আগে দা রাশ (The Rush), দা ওয়াসিস (The Oasis), পিঙ্ক ফ্লয়েড (Pink Floyd) এই ব্যান্ডগুলোই প্রগ্রেসিভ ধারার জন্ম দেন। কিন্তু মাইক এই ধারাটাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেন। মাইকের ড্রামিং গুরুদের ভেতর অনেকেই আছেন কিন্তু আমি তিনজনের নাম বলব। তারা হলেনঃ দা রাশ (The Rush) এর নেইল পার্ট (Neil Peart), লেড যেপ্পেলিন (Led Zeppelin) এর জন বোনহ্যাম (John Bonham) এবং দা হু (The Who) এর কেইথ মুন (Keith Moon)। আপনি মাইকের ড্রামিং খেয়াল করলেই বুঝবেন যে সেখানে যেমন নেইল পার্ট এর কম্বিনেসন ফিলস আছে ঠিক তেমনি বোনহ্যাম এর গ্রুভ আছে আবার কেইথ মুন এর শিফটিংও আছে। এখানে এই ইংরেজি উক্তিটিই মাথায় আসে “He borrowed the bricks from different mansons, but the house he built was entirely his own.

আরও পড়ুনঃ এনিমেলস্ যা বলে: পিঙ্ক ফ্লয়েডের দশম অ্যালবাম

গানে ড্রাম সোলো, আর তাল ভাঙ্গার ব্যাপারগুলি আগেও ছিল। কিন্তু মাইকই এই জিনিসগুলি নতুন করে গানে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যে তিনি কিংবদন্তি হয়ে গেছেন। বাংলাদেশের ড্রামারদের ভেতরেও তার প্রভাব রয়েছে। আর্টসেলের ড্রামার সাজু, অর্থহীনের সাবেক ড্রামার রায়েফ আল হাসান রাফা, মাইলস এর ড্রামার তুর্য- এদের সবার ড্রামস গুরুদের ভেতর মাইকের নামটি পাওয়া যাবে।

মাইকের ড্রামিং গুরুঃ উপরে বোনহ্যাম(Bonham), নিচে বামে কেইথ মুন (Keith Moon), নিচে ডানে নেইল পার্ট (Neil Peart)
মাইকের ড্রামিং গুরুঃ উপরে বোনহ্যাম(Bonham), নিচে বামে কেইথ মুন (Keith Moon), নিচে ডানে নেইল পার্ট (Neil Peart) ; Source:Pininterest

ইতিকথা

মাইক একবার এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন যে তিনি ড্রামিং এর সময় কোন নিয়ম মানেন না। তার মনে যা আসে তাই বাজান। কিন্তু দা ডান্স অব ইটারনিটি (The Dance Of Eternity),কন্সটান্ট মোশন ( Constant Motion), দা গ্লাস প্রিজন (The Glass Prison), দা ডার্ক ইটার্নাল নাইটস(The Dark Eternal Night), মেট্রোপলিস (Metropolis) এর মত গানগুলোর কিলার পার্টসগুলো এমনি এমনি মনে আসে কিভাবে! এর একটাই উত্তর হয়ত পাওয়া যাবে আর তা হল তিনি “মাইক Mind Freaking পর্টনয়” তাই !

Previous articleবোহেমিয়ান র‍্যাপসোডি: ফ্রেডি মারকারির এক অনন্য সৃষ্টি
Next articleআজম খান: কিংবদন্তি এক যোদ্ধার গল্প
Sanjay Das
Sanjay Das, currently a graduate student at the Department of economics, University of Dhaka. He's interested in music, philosophy, poetry, movies; things that are of little value to the material world. A confused soul, he rolls between the world of Nietzsche and Rousseau, he sometimes confuses Jim Morrison with Tagore. He has great enthusiasm for rock music, and sometimes he thinks he would be a perfect match in the 60s rock era, but eventually end up with writing on rock music, which he knows best. Sanjay das daydreams too much, piling up unrealistic thoughts.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.