রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অমিত রায়ের একটি উক্তি “ফ্যাশনটা হলো মুখোশ, স্টাইলটা হলো মুখশ্রী”। লাইনটি উল্লেখ করার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের সাথে যোগ সাযুজ্য আছে সত্তর দশকের গতানুগতিক শিল্পীদের সংগীত এবং প্রবাদপ্রতিম বাংলা গানের দল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র গানের মাঝে। সেই সময়টিতে শ্রোতারা রোম্যান্টিক আর ক্ল্যাসিকাল ধারার সঙ্গীতে সম্মোহিত ছিল। ঐ সময়ে বাংলা গানের আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে আবির্ভাব ঘটে এই গানের দলটির। স্বাধীনতা, রাজনীতি, ভালোবাসা, দারিদ্র্য, অন্যায়-অবিচার, একাকিত্বের মত ধারনাগুলো বারবার তাদের গানে উঠে এসেছে। তাঁরা গতানুগতিক সংগীতবোধের বাইরে নতুন ধারার বাংলা গানের স্টাইলের সাথে শ্রোতাদের পরিচয় করিয়ে দেন। সে জন্য সমালোচনাও কম হয়নি ব্যান্ডটিকে নিয়ে।
গৌতম চট্টোপাধ্যায়; যার হাতে বাংলা ব্যান্ড সংগীতের ভিত গড়ে ওঠে। স্বতন্ত্র এবং সৃজনশীলতা দুয়ের এক অদ্ভুত মিলন দেখতে পাই তাঁর মাঝে। আমাদের মাঝে তিনি নেই কিন্তু কেন এই দীপ্তিমান মানুষটি এখনও বাংলা সঙ্গীতের অনেকটা অংশ জুড়ে রেয়েছে ? কেন বর্তমান রক সঙ্গীতের অনুসারীরা তাকে পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখে? সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা এখন শুধু সময়ের দাবী। বাংলা গানের স্থিতাবস্থা ভাঙার যে ইশতেহার নিয়ে পথচলা “মহীনের ঘোড়াগুলি” ব্যান্ডিটির তার অন্যতম অগ্রদূত গৌতম চট্টোপাধ্যায়। ছোটবেলা থেকে সংগীত আবহে তাঁর বড় হওয়া। তাঁর ভাই এবং মহীনের ঘোড়াগুলি অন্যতম সদস্য প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “মণিদা (গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ডাক নাম) সবই বাজাতে পারত। যে কোনও ইনস্ট্রুমেন্টই খুব সহজে বাজিয়ে ফেলত তালিম ছাড়াই। নিজে নিজেই শিখে ফেলত বাজানোর আদবকায়দা।” প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় বাড়ির হাওয়াইয়ান গিটারটি স্প্যানিশ গিটারে রূপান্তরিত করে এবং প্রচুর ইংলিশ গান শুনে নিজেকে বিশ্বসঙ্গীতের সাথে পরিচয় করানোটা বোধহয় সময়য়ের চাইতে অগ্রসর চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। কাউন্টার কালচারের বিদ্রোহের যারা আদর্শ ছিলেন, যেমন- বিটলস্, রোলিং স্টোনস্, বব ডিলান, জিম মরিসনদের গান তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করলেন ‘আর্জ’ নামের একটি ব্যান্ড। নাইটক্লাব আর রেস্তোরাগুলোতে ইংরেজি গান কাভার (অন্য শিল্পীর গান করা) করেছেন তিনি।
একসময় গৌতমের মনে হল যেসব অডিয়েন্স তাদের শুনছে তথাকথিত প্রিভিলেজড শ্রেণীর। ব্যান্ডটি পরে আর বেশি দিন টেকেনি। সত্তরের দশকের সংগ্রামের আগুন ছড়িয়ে পরল পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়িতে যা নকশাল আন্দোলন নামে পরিচিত। দরিদ্র কৃষকদের ওপর ভূস্বামীদের অত্যাচার দানা বাধতে থাকল উগ্র রাজনীতিতে । গৌতম চট্টোপাধ্যায় আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তাই বিপ্লবের ডাকে শহর ছেড়ে গ্রামে পারি জমালেন। গ্রামের শ্রমজীবি মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম গানের মাধ্যমে পৌছে দিয়েছেন আমদের কাছে। মহীনের ঘোড়াগুলি প্রথম অ্যালবাম ‘সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক’ একটা বিখ্যাত গান ‘হায় ভালোবাসি’ । এই গানের মাধ্যমে তাঁর জীবনের কথাগুলো অদেখা শ্রোতাদের মুখোমুখি দাঁড় করান-
“ভালো লাগে ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে ভাসতে
প্রজাপতি বুনোহাঁস ভালো লাগে দেখতে
জানলার কোণে বসে উদাসী বিকেল দেখে
ভালোবাসি একমনে কবিতা পড়তে
যখন দেখি ওরা কাজ করে গ্রামে বন্দরে
শুধুই ফসল ফলায় ঘাম ঝরায় মাঠে প্রান্তরে
তখন ভালোলাগেনা লাগে না কোন কিছু
সুদিন কাছে এসো ভালোবাসি একসাথে আজ সব কিছু……”
জীবনে বৈপরীত্য দেখে বেড়ে ওঠা মানুষটি সংগীতে মাঝে জীবনের পরিপূরক রূপ খুঁজে পায়। পরবর্তি সময়ে বিপ্লব ছেড়ে নিজস্ব সংগীতে মননিবেশ করেন । তথাকথিত বিপ্লবীদের সমাজ সংস্কার পরিকল্পনা প্রতি তাঁর আস্থা ছিলনা। মহীনের ঘোরাগুলি ব্যান্ডের গিটারিস্ট, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধু তাপস দাস বলেছেন, “তথাকথিত বিপ্লবের প্রতি অনাগ্রহ থেকে সঙ্গীতকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে ছিলেন।” আবার বছর কুড়ি পরে অ্যালবামের ‘কথা দিয়া বন্ধু’ গানটির লাইনগুলো তাঁরই প্রতিছব্বি-
“কথা দিয়া বন্ধু ফিরা না আইলা
এ কেমন কথা হায় কি দশা
কানে বাজে তোমার কথা
বুকে বাজে তাই ব্যথা
কানের কথা বুকের ব্যথা হইয়া
আমার প্রাণে জাগায় যে হতাশা”
Feature Image: dammuygraphy.com