রবীন্দ্র সংগীতকে বিদেশী বাদ্যযন্ত্রের সাথে ভিন্ন ধারায় গেয়ে জনপ্রিয় করে তোলেন সাহানা বাজপেয়ী। রবীন্দ্র সংগীতকে শুধু এলিট শ্রেণীর মাঝে বেঁধে না রেখে সকল শ্রেণীর মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই গানের ফিউশন (গানের একাধিক ধারার মিশ্রণ অর্থে) করেন তিনি। সাহানার ভাষ্যমতে রবীন্দ্র সংগীতের নিগূড় যে মর্মার্থ সে কেবল রুচিসম্পন্ন বয়স্ক শ্রোতাদের মাঝেই নয় বরং তরুন প্রজন্মের মাঝেও ছড়িয়ে দেয়া উচিৎ।

সাহানা বাজপেয়ী
সাহানা বাজপেয়ী: Source: Facebook

১৯৭৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জন্ম নেয়া ভারতীয় বাঙালী এ শিল্পী বেড়ে ওঠেন শান্তিনিকেতনের সংগীতময় পরিবেশে। তার বাবা-মা দুজনই পশ্চিমবঙ্গের নর্থ বেঙ্গল বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক ছিলেন। সাহানার সংগীতের হাতেখড়ি বাবা বিমল বাজপেয়ীর হাত ধরেই। মাত্র তিন বছর বয়সেই সাহানা কন্ঠে তুলে নেন তার প্রথম রবীন্দ্র সঙ্গীত “সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে” গানটি। তিনি ১৯৮২ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠেন। এ সময় তিনি দীক্ষাগুরু হিসেবে পেয়েছেন বিজয় সিনহা, মধুমতি রায়, চিত্রা রায়, শ্যামলী বন্দোপাধ্যায়, চন্দন মুন্সী ও মিতা হকের মত প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের। শান্তিনিকেতনের পরিবেশ তার বেড়ে ওঠা ও ভাবনার গভীরতার পেছনের অন্যতম সহায়ক ছিল বলে তিনি মনে করেন।

সাহানা ও অর্ণব
সাহানা ও অর্ণব; Source: myspace.com

সাহানার কথা এলে তার সাথেই এসে পড়ে শায়ান চৌধুরী অর্ণবের কথা। শান্তি নিকেতনের সেকেন্ডারি লেভেলে পড়ার সময় “পাঠ ভবনে” তাদের পরিচয় হয়। সেখান থেকেই বন্ধুত্বের শুরু। গিটারের সাথে বাউল গানের মিশ্রনে নতুন কিছু করার উদ্দেশ্যে দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় অর্ণবকে প্রধান করে বন্ধুরা মিলে গড়ে তোলেন গানের দল “বাংলা”। সুফী আর বাউল গানের মিশ্রনে নতুন ধাঁচে গান করেন তারা। এ দলের হয়ে কলকাতা, দিল্লীসহ বিভিন্ন স্থানে গান করেছেন তিনি। পরবর্তী সময়ে অবশ্য সাহানা এ দল থেকে বেড়িয়ে যান। ২০০০ সালে অর্ণব ও সাহানা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হোন। এ সময় কলকাতার মেয়ে সাহানা ঢাকার বউ হিসেবে বেশ পরিচিতি পান। ২০০৮ সালে বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে আট বছরের সংসারের ইতি টানেন তারা। পরবর্তী সময়ে রিচার্ড হ্যারেট নামে এক ব্রিটিশ নাগরিককে বিয়ে করেন তিনি। রোহিনী এলিজাবেথ নামে এক কন্যাসন্তানের জননী তিনি। বর্তমানে তিনি ইংল্যান্ডেই বসবাস করছেন।

britain house of commons,pride of bengal awards,sahana bajpaie
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অভ কমোনস্-এ বেঙ্গল’স প্রাইড অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করছেন সাহানা; Source: Dhaka Tribune

বেঙ্গল মিউজিক কোম্পানি থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের ওপর ভিত্তি করে “নতুন করে পাবো বলে” শীর্ষক সাহানার প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। সঙ্গীতের প্রথম ও প্রধান অনুপ্রেরণা বাবা বিমল বাজপেয়ীকে অ্যালবামটি উৎসর্গ করেন তিনি। ২০১৫ সালে “যা বলো তাই বলো” শীর্ষক রবীন্দ্র সঙ্গীতের দ্বিতীয় অ্যালবাম বের হয় তার। লোকসঙ্গীতের প্রতি বরাবরই টান ছিল সাহানার। তাই লোকগীতি নিয়েই তার তৃতীয় অ্যালবাম “হাওয়া বদল” প্রকাশিত হয়। তার প্রতিটি অ্যালবামই দুই বাংলার মানুষের থেকে পেয়েছে অগাধ ভালোবাসা। এছাড়াও তাসের দেশ, ফ্যামিলি অ্যালবাম ও আন্ডার কন্সট্রাকশন নামের ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের প্লে ব্যাক গায়িকা হিসেবেও কন্ঠ দিয়েছেন তিনি। অর্ণবের চাইনা ভাবিস, হোক কলরব, ডুবসহ বিভিন্ন জনপ্রিয় অ্যালবামগুলোতে গান লিখার পাশাপাশি কন্ঠও দিয়েছেন তিনি।

sahana bajpaie with moushumi voumik
মৌসুমি ভৌমিকের সাথে সাহানা বাজপেয়ী; Source: Facebook

বাংলা ব্যান্ডের থেকে সরে আসার পর কলকাতায় বছরখানেক শিশুদের গান শেখান তিনি। ২০০০ সালের দিকে ঢাকায় আসেন সাহানা। ২০০৫ সালে ঢাকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীর লেকচারার হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। শিক্ষকতাকে তিনি মনেপ্রাণে ধারণ করেন বলে শিক্ষকতা ও গান দুটোই তার কাছে সমান সাধনার উল্লেখ করে এক সাক্ষাৎকার দেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে এসওএএস হিসেবে নিযুক্ত হোন তিনি।

আরও পড়ুন: মৌসুমি ভৌমিক: আবেগ-বেদনা-একাকীত্ব লেপ্টে থাকে যার গানে

পুরনো দিনের রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী সাহানা দেবীর নাম থেকেই সাহানার বাবা কন্যার নাম রাখেন। বাবার স্বপ্ন পুরোটাই সত্যি করেছেন সাহানা। সঙ্গীতকে শুধু গাওয়ার জন্যে না, নিজের ভেতর ধারণ করেছেন তিনি। একটি কাজকে প্রতিষ্ঠিত করতে একস্থানে থাকাটাকে জরুরি মনে করলেও সেভাবে থাকা হয়ে ওঠেনি এ শিল্পীর। কিন্তু ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরো কাজের ইচ্ছে পোষণ করেন তিনি। আনন্দ নিয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়ার যে শিক্ষা শান্তিনিকেতন থেকে তিনি পেয়েছেন তার ভাবার্থ সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে রবীন্দ্র সংগীতকে কেবল ঘুমপাড়ানি গান থেকে বের করে, সকলের জন্যে করে তোলার আশা করেন তিনি।

Previous articleএনিমেলস্ যা বলে: পিঙ্ক ফ্লয়েডের দশম অ্যালবাম
Next articleমহীনের ঘোড়াগুলি ও বাংলা সংগীতের ম্যাজিসিয়ান গৌতম চট্টোপাধ্যায় (পর্ব ১)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.