টিএসসির আড্ডায়, মাঝনদীতে নৌকায় কিংবা রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে, একদল তরুণ অ্যাকোস্টিক গিটারে সুর তুলে ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’, ‘ফেরারী এ মনটা আমার’ গাইছে এটা বেশ সাধারণ একটা দৃশ্য। ছয় তারের ঝংকার আর বাঙালির রোমান্টিক আবেগের মিশেলে বাংলাদেশে ব্যান্ডসংগীতকে এতটা সর্বজনীন করায় যার অবদান কখনো ভোলা যাবেনা তিনি হলেন, আইয়ুব বাচ্চু (এবি) এলআরবি-এর লিড গিটারিস্ট। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতপ্রেমী শ্রোতাদের কিংবা উঠতি তরুণ কোনো গিটারিস্টের দেশীয় অনুপ্রেরণার তালিকায় তাঁর নাম থাকে এবং থাকবে সবার ওপরের দিকে।
ছোট্ট রবিন এর গিটার প্রেমের শুরু
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের চট্টগ্রাম শহরের এক বনেদি পরিবারে জন্ম রবিনের (আইয়ুব বাচ্চুর ডাক নাম)। সত্তর এর দশক ছিলো পপগুরু আজমখানের, কৈশোরের রবিন ছিলো যার অন্ধ ভক্ত। আজমখানেরই এক অনুষ্ঠানে, গুরুর পাশে ঝাঁকড়া চুলে, খোলা শার্টে, অসাধারণ দক্ষতায় গিটারের সুর তুলে ছোট্ট রবিনের মন কেড়ে নেন বাংলাদেশের অন্যতম কিংবদন্তী গিটারিস্ট নয়ন মুন্সী। তাঁর এই অনবদ্য বাজনা শুনে রবিন ঠিক করে ফেললেন, জীবনে আর কিছু চান না, শুধু এমন অসাধারণভাবে গিটার বাজাতে চান।
গিটার ঈশ্বর হেনড্রিক্সের মত বাজাতে চাইতেন
পরিবারে কখনোই সংগীতচর্চার খুব একটা অনুকূল পরিবেশ ছিলো না। তবুও জীবনের প্রথম অ্যাকোস্টিক গিটারটি পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকে ১৯৭৩ বা ’৭৪ সালের দিকে। তখন সময়টা মিউজিক স্কুল বা ইউটিউব ভিডিও’র ছিলো না, যা শিখতেন নিজের চর্চা ও আগ্রহের তাড়নায়ই। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় বন্ধুর থেকে ‘টিসকো’ (Teisco) গিটার ধার নিয়েও চালিয়ে গেছেন ছয় তারের সুরচর্চা। চট্টগ্রামেই বার্মার একজন গিটার শিক্ষকের কাছে মূলত শেখার শুরু, তার কাছেই কর্ড তোলা শেখেন, শেখেন কর্ডের সম্পর্ক ও সংযোগ। আইয়ুব বাচ্চু সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন গিটার ঈশ্বর-খ্যাত জিমি হেনড্রিক্সের বাজানো দেখে। তাঁর মতই নোট অনুসরণ করে নয় বরং আবেগ অনুসারে বাজাতে চেয়েছেন সবসময়। এছাড়াও প্রিয় গিটারিস্ট ছিলেন স্টিভ ভাই, জো সাত্রিয়ানি, রাস্টি কুলি, অ্যান্ডি জেমস।
ফিলিংস থেকে এলআরবি, জয় করছেন লাখো শ্রোতার মন
ব্যান্ডসংগীত জগতে এবি’র পদচারনা শুরু হয় জন্মস্থান বন্দর নগরী থেকে, ১৯৭৮ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ব্যান্ডদল ফিলিংস এ যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। ফিলিংস-এর সাথে তিন বছর তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন হোটেলে ইংরেজি গান বাজিয়েছেন। সত্তরের দশকের শেষ ভাগ ও আশির দশক থেকে বাংলাদেশে শ্রোতাদের কাছে ইংরেজি গান, হার্ড-রক, ব্লুজ, অল্টারনেটিভ রক- এসব পরিচিতি পেতে থাকে তাঁর গানের মধ্য দিয়ে। শহীদ মাহমুদ জঙ্গির ‘হারানো বিকেলের গল্প’ গানে প্রথম কণ্ঠ দেন আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৮০ সালের দিকে তিনি জনপ্রিয় সোলস ব্যান্ডের সাথে গান বাজাতেন। এই দলের সাথে তিনি ১০ বছর যুক্ত ছিলেন।
সোলসে থাকার সময়ই ১৯৮৬ সালে তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’ বের হয়। ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘ময়না’ মুক্তি পায় যার মাধ্যমে মূলত শ্রোতাদের নজর কাড়েন তিনি।
১৯৯০ সালের পর থেকেই নিজের ব্যান্ড গড়বেন বলে মনস্থির করেন আইয়ুব বাচ্চু, ছেড়ে আসেন সোলস। সেই সূত্রে ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে তাঁর ব্যান্ড ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’, সংক্ষেপে ‘এলআরবি’। পরে নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’ হলেও সংক্ষিপ্ত রূপ সেই এলআরবি-ই থাকে।
এরপর বাংলা ব্যান্ড সংগীতকে তার সুর আর গানে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশে প্রথম ডাবল অ্যালবাম এলআরবি-১ ও এলআরবি-২ যেন তার ব্যান্ড বিপ্লবী মনেরই প্রতিফলন। এই দুটো অ্যালবাম ব্যাপক সাড়া জাগায় শ্রোতাদের মাঝে।
এরপর নিয়মিত প্রকাশ পেতে থাকে অ্যালবামগুলো-
- সুখ
- তবুও
- ঘুমন্ত শহরে
- স্বপ্ন
- আমাদের বিস্ময়
- মন চাইলে মন পাবে
- অচেনা জীবন
- মন আছে নাকি নাই
- স্পর্শ
সুখ অ্যালবামের ‘সুখ’, ‘চলো বদলে যাই’, ‘রুপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’ উল্লেখযোগ্য গান। ‘চলো বদলে যাই’ বাংলাদেশের সংগীত জগতে অন্যতম জনপ্রিয় একটি গান। গানটির কথা লিখেছেন ও সুর করেছেন বাচ্চু নিজেই। এই একটি গান অসংখ্যবার, বিভিন্ন কনসার্টে তাকে গাইতে হয়েছে ভক্তদের অনুরোধে। ২০১২ সালে ব্যান্ডটির সর্বশেষ অ্যালবাম ‘যুদ্ধ’ বের হয়েছে। ব্যান্ডটির একমাত্র লাইভ অ্যালবাম ‘ফেরারী মন’ ১৯৯৬ সালে মুক্তি পায়।
সোলসে থাকার সময় দুটি একক অ্যালবামের কাজ হলেও নিজের ব্যান্ড তৈরির পর সেদিকে আবারো নজর দেন আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৯৫ সালে চতুর্থ ব্যান্ড অ্যালবাম ‘ঘুমন্ত শহরে’র সঙ্গে তিনি বের করেন তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। এই অ্যালবামের ‘কষ্ট কাকে বলে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হৃদয়’ ও ‘আমিও মানুষ’ বেশ জনপ্রিয় হয়। তিনি বাংলা ছবিতেও প্লেব্যাক করেছেন। ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ বাংলা ছবির অন্যতম একটি জনপ্রিয় গান। এটি তাঁর গাওয়া প্রথম চলচ্চিত্রের গান। ছবিটির নাম ছিল ‘লুটতরাজ’। ‘সাউন্ড অব সাইলেন্স’ আইয়ুব বাচ্চুর একমাত্র যন্ত্রসংগীতের (Instrumental) অ্যালবাম।
বিশ্ব আসরও মাতিয়েছেন ছয় তারের জাদুতে
কেবল বাংলাদেশেরই খ্যাতনামা গিটারিস্ট ছিলেন না, পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের রক গিটারিস্টদের মধ্যেও অন্যতম এক নাম আইয়ুব বাচ্চু। তিনি ভারতের ‘আইআইএম জোকা রকফেস্ট’, ‘বেনসন এন্ড হেজেস স্টার সার্চ’, ‘ডি’রকস্টার’ এবং আরও অনেক আঞ্চলিক কম্পিটিশনে বিচারক হবার সম্মান লাভ করেন। আইয়ুব বাচ্চুই একমাত্র বাংলাদেশি রক গিটারিস্ট যিনি নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে পারফর্ম করেছেন। এছাড়া অস্ট্রিয়া, লন্ডন, সিঙ্গাপুর, কাতার, দুবাই, হংকং, সাইপ্রাস বলতে গেলে পুরো পৃথিবী জুড়েই ছড়িয়েছেন তার ছয় তারের জাদু। এত দেশ ঘুরেও নিজ দেশের সম্মান সবসময় ছিলো আইউব বাচ্চুর কাছে সবার উপরে। এনিয়ে একটি গল্পও আছে।
যে গিটার দ্বিতীয়বার বাজাননি!
১৯৯৮ সালে প্রথম ব্যান্ড নিয়ে নিউইয়র্ক পারফর্ম করতে যান। শো শেষে নিউইয়র্ক গিটার সেন্টারে ঘুরতে গিয়ে কাঁচের বাক্সবন্দী ‘আইব্যানেজ’ গিটারে চোখ পড়ে গিটারপ্রেমী এবির। দোকানের ব্যবস্থাপককে গিটারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে গেলে, বাংলাদেশী পরিচয় জেনে সে বলে দিলো, “ এই গিটার তোমার মতো বাংলাদেশির জন্য নয়। এটা এখানে সবচেয়ে দামি গিটার, তুমি বরং অন্যটা দেখ।”
দেশকে অপমান করে বলা কথাটাতে বেশ আহত হলেন এবি, মনে জেদ চেপে গেল। অনুরোধ করলেন একবার হাতে নিয়ে দেখতে দেওয়ার জন্য, দলের সবার কাছে যতটুকু টাকা আছে তাই দিয়ে হলেও গিটারটি নিবেন। গিটার হাতে নিয়ে যখন বাজানো শুরু করলেন দোকানের প্রায় সবাই জড়ো হয় গিয়েছিলো। দোকানের সেই ব্যাবস্থাপকও তার বাজানো শুনে মুগ্ধ হয়ে অর্ধেক দামে গিটারটি দিতে চাইলেও এবি বিনয়ের সঙ্গে বলেন “যে গিটারের জন্য দেশ অপমানিত হয়, সেই গিটার আইয়ুব বাচ্চু দ্বিতীয়বার বাজায় না।
চলে গেলেন রূপালী গিটার ফেলে
আইয়ুব বাচ্চুর দীর্ঘ চার দশকের সংগীত জীবনে দু একটি গান ছাড়া প্রায় সবগুলোই ছিলো সুপার হিট। ব্যক্তিত্বে, তারকাখ্যাতিতে, বন্ধুপ্রিয়তায়, জীবন দর্শনে ভক্তদের, অনুজ গিটারিস্ট বা ব্যান্ডসংগীত প্রেমীদের সত্যিকার আইডল হতে পেরেছিলেন এবি। আর ভক্ত শ্রোতাদের এই ডাকই সবচেয়ে ভালোবাসতেন তিনি।
২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর মগবাজারে নিজ বাসভবন থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে হার্ট অ্যাটাকের কারণে বাংলা ব্যান্ড সংগীতের এই মহাতারকার মৃত্যু হয়। বাংলা সংগীত জগতে অপূরণীয় শূন্যতা তৈরী করে, আর শত শত ব্যান্ড শিল্পীদের অভিভাবকহীন করে পুরো জাতিকে কাঁদিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন ওপারে। তবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, বাংলার রকপ্রেমী আর গিটারিস্টদের বিশাল এক অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন এবি।