আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি
জাতীয় সংগীতের এ চরণগুলোর সাথেই পার হয়েছে স্কুলের দশটি বছর। প্রতিদিন সকালের যে কাজটি একটা সময় ছিল চরম অপছন্দের আজ বাসার পাশের স্কুলের বাচ্চাদের কণ্ঠে সে গানই করে তোলে নস্টালজিক। একটি স্বাধীন দেশের জন্যে অন্যতম প্রধান এক অঙ্গ ‘জাতীয় সংগীত’। প্রতিটি ছোট-বড় জাতীয়/রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে বাজানো জাতীয় সংগীতের রয়েছে অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। একটি দেশ ও দেশের মানুষের আবেগ, গৌরব এবং ঐতিহ্যকে তুলে ধরে জাতীয় সংগীত।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচনা তারও প্রায় ছয় দশক পূর্বে। ১৯০৫ সালে মুসলিম ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে বাংলাকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হলে বঙ্গভঙ্গ রোধের জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠা স্বদেশী আন্দোলনকে সমর্থন করে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির রচনা করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি বলে এর সঠিক রচনাকাল জানা যায় না। সত্যেন রায়ের মতে ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার একটি প্রতিবাদ সভায় গানটি প্রথম গাওয়া হয়। তবে এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঐ বছর ৭ সেপ্টেম্বর (১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র) সঞ্জীবনী এবং একই বছর বঙ্গদর্শন পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতে গানটি প্রকাশিত হয়। বিশিষ্ট রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্ত কুমার পালের মতে ‘আমার সোনার বাংলা’ বাউল সুরে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্ট কলকাতার টাউনহলে ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ প্রবন্ধপাঠের আসরে প্রথম গাওয়া হয়েছিল। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর গীতবিতান কালানুক্রমিক সূচী গ্রন্থেও গানটির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে একই কথা উল্লেখ করেন।
দাদরা তালের এ গানটির সুর ১৮৮৯ সালে গাওয়া গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটির সুর থেকে নেয়া হয়েছে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহতে নিজেদের জমিদারী দেখাশোনা করতে গেলে সেখানকার ডাকপিয়ন বাউল গগন চন্দ্র দাস, রবীঠাকুরের চিঠি নিয়মিত পৌছে দেয়ার সূত্রে পরিচিত হোন। সে সময় ডাকপিয়নকে হরকরা বলা হতো বলে তিনি ‘গগন হরকরা’ নামেই পরিচিতি পান। তার গাওয়ার সহজাত বৈশিষ্ট্য এবং প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভা আকৃষ্ট করে রবীঠাকুরকে। মধ্যবিত্ত বাঙালিদের মাঝে বাউল গানকে নতুন করে পরিচিত ও জনপ্রিয় করানোর লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কাজ করে গেছেন তারই অংশ হিসেবে তিনি বেশ কিছু গানে বাউল সুর ব্যবহার করেন। সরলা দেবীকে লিখা ‘ছিন্নপত্র’-এর চিঠিগুলোতে একাধিকবার গগন হরকরার উল্লেখ করেন রবীঠাকুর। অবশ্য এর আগেই ১৩০৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে সরলা দেবী চৌধুরানী তাঁর শতগান সংকলনে গগন হরকরা রচিত গানটির স্বরলিপি প্রকাশ করেছিলেন। শিল্পী গোপালচন্দ্র সেনের কন্ঠে গানটি প্রথম রেকর্ড করা হয়। সে সময় বাঙালিদের মাঝে জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ করতে গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সাথে সাথে পুনরায় বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয়। এ সময় পাকিস্তানি শাসকদের বাংলাবিদ্বেষী মনোভাবের ফলস্বরূপ পূর্ব বাংলায় (পূর্ব পাকিস্তান) রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। ১৯৬১ সালে বিশ্বব্যাপী কবির শততম জন্মবার্ষিকীর উৎসবের ছটা এসে লাগে পূর্ব পাকিস্তানেও। শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বুদ্ধিজীবীদের একটি দল পূর্ব পাকিস্তানেও কবির জন্ম শতবার্ষিকী পালন করেন। একইসাথে এ সময় বাঙালির প্রাণের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে জন্ম হয় ‘ছায়ানট’ এর। বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রতিষ্ঠিত করে ছায়ানট। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবেও পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করে বাঙালি। বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে জাতীয় সংগীতের আঙ্গিকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ স্বাধীন বাংলার কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলে ৩ মার্চ ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ঘোষিত ইশতেহারে গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে প্রথম জাতীয় সংগীত হিসেবে গানটি গাওয়া হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায় গানটির বর্তমানে প্রচলিত যন্ত্রসুর করেন।
অবশ্য কথিত আছে গানটির সুর নিয়ে একসময় কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। বলা হয় সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া রেকর্ড থেকে যে সুর শুনে শিল্পীরা গানটি তুলেছিলেন সে সুর থেকে নিজেরাই খানিকটা সরে যান। আর সেই সুরই গাওয়া হয়ে আসছে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা কাল থেকে এ পর্যন্ত। এ বিষয়ে অধ্যাপক সনজিদা খাতুন তাঁর আকাশ ভরা কোলে গ্রন্থের ‘আমার সোনার বাংলা’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন “বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ‘আমার সোনার বাংলা’-র সুর আর স্বরলিপি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। তখন ক্যাবিনেট ডিভিশনের এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বলেন যে সুর গেয়ে দেশকে স্বাধীন করা হয়েছে তাই আমাদের জাতীয় সংগীতের সুর। বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত আমাদের ভুলকে শুদ্ধ করে দিয়েছিল। আজও সেই সুরেই গাওয়া হয় ‘আমার সোনার বাংলা’।”
১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারী বাংলাদেশ সরকার পঁচিশ লাইনের গানটির প্রথম দশ লাইন জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ‘প্রথম ভাগ’ (প্রজাতন্ত্র) এর ৪(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম দশ চরণ।” যন্ত্রসংগীত ও সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার করা হয় গানটির প্রথম চার লাইন। একই বছর বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহার করা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির স্বরলিপি বিশ্বভারতী সংগীত বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত করা হয়।
১৯৭০ সালে জহির রায়হান, তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত বিখ্যাত ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে সর্বপ্রথম জাতীয় সংগীতের চলচ্চিত্রায়ন করেন। ২০০৬ সালে শ্রোতাদের পছন্দ অনুসারে বিবিসি বাংলার তৈরি সেরা বিশটি বাংলা গানের তালিকায় গানটি প্রথম স্থান দখল করে। দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকার মতে ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে অংশ নেয়া ২০৫ টি দেশের জাতীয় সংগীতের তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত দ্বিতীয় হয়। প্রথম হয় উরুগুয়ের জাতীয় সংগীত। বাংলাদেশের ৪৪তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে ৩ লাখেরও বেশী বাঙালি একসাথে জাতীয় সংগীত গাওয়ার মাধ্যমে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ তালিকাভুক্ত করে।
২০০৬ সালে আইনজীবী কালিপদ মৃধার মোবাইলের রিংটোন এবং ওয়েলকাম টিউন হিসেবে জাতীয় সংগীতের বাণিজ্যিক ব্যবহারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংগীতকে মোবাইল ফোনে রিংটোন ও ওয়েলকাম টিউন হিসেবে এবং বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করাকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। সে সময় আদালত গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংককে ৩০ লাখ টাকা করে জরিমানা করেছিলো।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে বাণীসহ প্রতিদিন বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত জাতীয় সংগীতের সুরে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হতো। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে ১৯৭৬ সাল হতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাণীসহ জাতীয় সংগীতের প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়। এর কিছুকাল পরে বাংলাদেশ বেতারেও জাতীয় সংগীত প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমানের পতনের বেশ কিছু সময় পর থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে জাতীয় সংগীতের শুধু যন্ত্রসংগীত বাজানো হয়।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নিয়ে একাধিকবার বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আর এ বিতর্কের প্রধান উপজীব্য ছিল জাতীয় সংগীতের জন্ম ইতিহাস। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করে রচিত গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে বর্তমান বাস্তবটায় দাঁড়িয়ে কতটুকু যৌক্তিক এবং একইসাথে বাংলার বিশাল একটি অংশ বাঙালি মুসলমানের কোন উল্লেখ না থাকাকে ঘিরেই এ বিতর্ক আবর্তিত হয়। ধারণা করা হয় ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী’ রাজনৈতিক চেতনার দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এ কারণেই জাতীয় সংগীতের প্রচার বন্ধ করে দেন। অন্যদিকে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’এ বিশ্বাসী এবং স্বাধীনতার পক্ষশক্তি হিসেবে দাবি করা আওয়ামী লীগ কখনোই জাতীয় সংগীত নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। এছাড়া দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গানটিও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে বিবেচনাও এসেছিল বলে জানা যায়। তবে দুটি গানের মধ্যে ‘আমার সোনার বাংলা’ বেশী প্রাসঙ্গিক এবং অর্থপূর্ণ বলে একেই গ্রহণ করা হয়েছে। এ দুটি গান বাদেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, ভূখণ্ড এবং সংস্কৃতিকে আরো বেশী উপস্থাপন করতে পারা গানগুলো কেন বিবেচনায় আসেনি সে প্রসঙ্গটিও এক্ষেত্রে প্রশ্নসাপেক্ষ।
বিশ্ব ইতিহাসে জাতীয় সংগীতের প্রচলন খুব বেশী দিনের না। জাপানের জাতীয় সংগীত ‘কিমি গা ইয়ো’ ৭৯৪ থেকে ১১৮৫ সালের মধ্যে রচিত হলেও ১৮৮০ সালের পর জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পায়। পরবর্তী সময় ব্রিটিশ এবং অ্যামেরিকানরা নিজেদের গৌরব এবং জয়জয়কার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে জাতীয় সংগীত রচনা করেন। বর্তমানে পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীন দেশেরই জাতীয় সংগীত রয়েছে- কিছু কিছু দেশের রয়েছে একাধিক জাতীয় সংগীত। তবে একই ব্যক্তির দুইটি দেশের জাতীয় সংগীত রচনার বিরল সম্মানের একমাত্র অধিকারী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
Featured image: Sheikh Nayeem Islam
This write-up in Bengali tells how ‘Amar Sonar Bangla’ became the national anthem of Bangladesh. The references are hyperlinked into the write-up.
Nice