দেশের জন্য প্রাণ দেয়া শহীদদের নামের একটি তালিকা বানাতে বললে সে তালিকা কতখানি লম্বা হবে সে ধারণা আমার নেই। কিন্তু শিল্পের জন্য শহীদের তালিকা তৈরি করা হলে তাতে জ্বলজ্বল করবে একটি নাম- কার্ট কোবেইন। অবশ্য পাঠক এটাকে বাড়াবাড়ি ভাবতে পারেন। এমনকি দাবীটিকে ভাবতে পারেন আবেগপ্রবণ উন্মত্ততাও। দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার মত এক দাবী হলেও যুক্তি দিয়েই কথাটাকে উপস্থাপনের চেষ্টা করব।

আমেরিকার ওয়াশিংটন শহরের অ্যাবার্ডিনে জন্ম নেওয়া কার্টকে বুঝতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে তার সময়কে। কার্ট শুধু শিল্পীই নন, তিনি তার সময়ের প্রতিচ্ছবি। কার্টের জন্ম ১৯৬৭ সালের ২০ ফেরুয়ারী। কার্ট যে সময়ে জন্মেছিলেন সে প্রজন্মকে বলা হয় জেনারেশন এক্স বা এমটিভি (MTV) জেনারেশন (মিউজিক চ্যানেল এমটিভি এর নামকরনে করা)। ডগলাস কুপল্যান্ড তার উপন্যাস জেনারেশন এক্সঃ টেলস ফর অ্যান অ্যাক্সেলেরেটেড কালচার (Generation X: Tales for an Accelerated Culture) এর মাধ্যমে শব্দটি সবার কাছে পৌছে দেন। তাঁর মতে ষাটের দশকের মাঝমাঝি থেকে আশির দশকের আগ পর্যন্ত সময়ের মাঝে জন্ম নেয়া প্রজন্মই জেনারেশন এক্স। এরা অ্যামেরিকার ইতিহাসে সেই প্রজন্ম যারা কিনা জীবনযাত্রার মানে পিছিয়ে ছিল তাদের আগের প্রজন্মগুলোর চেয়ে। এই সময়টাতেই অ্যামেরিকায় ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়ে যায়। বাবা-মা দুজনেই কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়ার ফলাফলস্বরূপ সন্তানদের দেখাশোনা করার মতও ছিলো না কেউ। এছাড়া অ্যামেরিকান সরকারের বয়ঃপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক নীতিমালার কারণে এই প্রজন্ম ছিল ছন্নছাড়া, উদ্ভ্রান্ত এবং রাগী মেজাজের। তাঁরা তাদের বাবা-মায়ের কথা গ্রাহ্য করত না এবং পুরাতন ধ্যান ধারনাগুলোর প্রতি অবজ্ঞা দেখাতো। তাই এই প্রজন্মের শিশুগুলো পরিবারের চেয়ে বন্ধুদের সাথেই সময় কাটাত বেশী। এবার ফিরে আসি কার্ট প্রসঙ্গে।

ছোটবেলা থেকে এমনই নিঃসঙ্গ ছিলেন কার্ট
ছোটবেলা থেকে এমনই নিঃসঙ্গ ছিলেন কার্ট; Source: Time Magazine

ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকতে পছন্দ করা কার্টের শৈশব ছিল উচ্ছ্বাসপূর্ণ। তাঁর জীবনের প্রথম ধাক্কাটি আসে যখন সাত বছর বয়সে তার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়। এরপর থেকে কার্টের ব্যক্তিত্ব ও মেলামেশায় বিরাট পরিবর্তন আসে। পরিবার এবং নিজেকে নিয়ে অনেক বেশী সংকুচিত থাকায় স্কুলে সে অন্যদের সাথে ঠিক মিশতে পারত না। এ কারণে স্কুলের ছেলেরাও তাঁর পেছনে লেগে থাকত এবং সমকামী বলে ক্ষেপাত। এসব থেকে ধীরে ধীরে কার্টের মনের ভেতর তার প্রজন্মের অন্যদের প্রতি ঘৃণা জন্মাতে থাকে। পরবর্তী সময়ে তার বাবা এবং সৎ মায়ের সাথে থাকার সময় তার ভেতরে উদ্ধত এক ব্যক্তিত্বও প্রকাশ পায়।

কার্টের জীবনে প্রথম ব্যান্ড ছিল ফিক্যাল ম্যাটার। পরে সে ক্রিস্ট নোভোসেলিক এর সাথে ‘নির্ভানা’ ব্যান্ড গঠন করেন। বুদ্ধবাদ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় মূলত বুদ্ধবাদের ‘নির্বাণ’ শব্দটি থেকে নামকরন করেন কার্ট। তিনি মনে করতেন সংগীত মানুষের মনের মুক্তি দেয়। এই নির্ভানা ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম ব্লিচ (Bleach) খুব একটা সফল হয়নি। সিয়াটল (Seattle) মিউজিক সিনারির ছোট এই ব্যান্ড বিশ্বপরিচিতি পায় তাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম নেভারমাইন্ড (Nevermind) এর মাধ্যমে। এই অ্যালবামের মাধ্যমে বিশ্ব শুনতে পায় নতুন শব্দ। একদিকে কার্টের গিটারের ডিস্টরশনে তার উদ্ধত উন্মত্ততা আর রাগ ফুটে ওঠে, অন্যদিকে গানগুলোর ভেতর কাজ করে এক অদ্ভূত সুর। পূর্বের পাঙ্ক রককে তিনি নতুনভাবে সংজ্ঞায়ন করেন যা কিনা পরে গ্রাঞ্জ রক হিসেবে পরিচিতি পায়। এই অ্যালবামের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন জেনারেশন এক্স এর মুখপাত্র। তবে এ আখ্যাকে বরাবরই অস্বীকার করেছেন তিনি। এখানেই তার শিল্পসত্ত্বার সাথে সংঘর্ষ বাঁধে পাবলিক ইমেজের। কার্ট নিজেও ভাবেননি অ্যালবাম এতটা হিট করবে। তাঁর এই জনপ্রিয়তা ও টাকার সাথে তার শিল্পসত্ত্বার বিরোধে কার্ট ধীরে ধীরে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে এবং বেড়ে যায় তাঁর মাদক নেয়ার প্রবণতা।

বিখ্যাত এমটিভি আনপ্লাগড শোতে কার্ট
মৃত্যুর আগের শেষ বিখ্যাত এমটিভি আনপ্লাগড শোতে কার্ট; Source: Time Magazine

একটা সময় তিনি দৈনিক ৬০০ ডলার অর্থমূল্যের হেরোইন নিতেন। পাকস্থলিতে ব্যথার উপশমের জন্য কার্ট হেরোইন নেয়ার দাবী করলেও সে কথার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ধীরে ধীরে ব্যান্ড থেকে শুরু করে তার স্ত্রী কোর্টনি লাভ, মানুষ- সব কিছু থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকেন কার্ট। একটা শো-তে বেশী মাদক নেওয়ার কারণে অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। পরে ডাক্তার ডেকে চেতনা ফিরিয়ে আনার ওষুধ দিয়ে তাকে আবার স্টেজে তোলেন কোর্টলি। যত দিন যাচ্ছিল কার্ট ততই যেন সবকিছু থেকে বিছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে ১৯৯৪ সালের ৮ এপ্রিল শটগানের গুলিতে ছিন্নভিন্ন মাথার মৃতদেহ পাওয়া যায় তার। তার মৃত্যুর কারন নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেন আত্মহত্যা, কেউ বলেন কোর্টনি লাভের ষড়যন্ত্র।

কার্টের লিরিক্সের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায় সেখানে বারবার দ্বন্দাত্মক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কার্ট বিশ্বাস করত মানুষ বরাবরই দ্বান্দ্বিক, দ্বান্দ্বিক জীবনের সবকিছুই। অনেকেই বলেন তার লিথিয়াম (Lithium) গানটি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস থেকে, রেপ মি (Rape me) গানটি ধর্ষনের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বিখ্যাত গান লিখেছেন নিজ প্রজন্মকে নিয়ে- স্মেলস লাইক টিন স্পিরিট (Smells Like Teen Spirit)। সামথিং ইন দা ওয়ে (Something in the way) গানটি তার বাড়িছাড়া অবস্থায় হুইস্কা নদীর নিচে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা।

তবে একজন ভক্ত হিসেবে আমি মনে করি তার গানকে এরকম একতরফা করে বিচার করলে তা শিল্পগুণ হারায়, ছোট হয়ে যান শিল্পী নিজে। কার্ট নিজে স্বীকার করছেন যে তার কিছু গানের কোন অর্থ নেই, ওগুলো শুধুই একসাথে জোড়া দেওয়া কিছু কবিতা। কিছু গান তিনি ইচ্ছে করে দ্বান্দ্বিক শব্দ ব্যবহার করে অর্থহীন করে তুলেছেন। বরাবরই তিনি প্রধান করেছেন গানের মেলোডিটাকে। এজন্যই ওইরকম গিটার ডিস্টরশনের মাঝেও সুর তৈরী করার ক্ষমতা ছিল কার্টের।

নির্ভানা এর লাইভ শোতে কার্ট
নির্ভানা এর লাইভ শোতে কার্ট ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Source: Rolling Stone Magazine

দা ডোরস (The Doors) ব্যান্ডের গিটারিস্ট রবি ক্রিগার কিংবদন্তি জিম মরিসনকে নিয়ে একবার বলেছিলেন, “কিছু মানুষ নিজেকে ধ্বংসের মাধ্যমে তার সৃষ্টিসত্ত্বাকে প্রকাশ করেন, জিম এমনই একজন।” কার্টও হয়তো তেমনই একজন ছিলেন যে কিনা পরে জিম মরিসনের সাথে ২৭ এর ক্লাবে পড়ে গিয়েছেন। নির্ভানা ব্যান্ডের ড্রামার ডেভ গ্রোল পরে বলেছিলেন যে তিনি জানতেন যে কার্ট তাড়াতাড়ি চলে যাবে পৃথিবী থেকে।

আসলে কার্টের দুটো সত্ত্বা ছিল- একটি হলো ছোট অ্যাবার্ডিনের নিঃসঙ্গ এক শিল্পী আর অন্যটি টাকা ও খ্যাতিসম্পন্ন মাদকাসক্ত হতাশ এক স্বেচ্ছাচারী। শেষ করি ২ টা কথা দিয়ে-

কার্টের সুইসাইড নোটের নিল ইয়াং এর বিখ্যাত সেই কথা- “নিভে যাওয়ার চেয়ে পুড়ে শেষ হয়ে’ যাওয়া ভাল” ( It’s better to burn out than to fade away)। আর অন্যটি হল সমালোচক রবার্ট হিউজেস এর কথা- “যে শিল্পী যত বড় তাকে ঘিরে রহস্যও তত বেশী। সঠিকতা কম মেধাবীদের সান্তনা পুরস্কার” (The greater the artist, the greater the confusion. Perfect confidence is granted to the less talented as a consolation prize)। এ দুটো কথার মাঝের লম্বা পথটুকু থাকলো পাঠকদের হেঁটে পাড়ি দেয়ার জন্যে।

Featured Image: cheatsheet.com
This ia a biographical write-up on Kurt Cobain. The references are hyperlinked into the write-up.
Previous articleআমার সোনার বাংলা যেভাবে আমাদের জাতীয় সংগীত হলো
Next articleক্লাপ্টনই ঈশ্বর!
Sanjay Das, currently a graduate student at the Department of economics, University of Dhaka. He's interested in music, philosophy, poetry, movies; things that are of little value to the material world. A confused soul, he rolls between the world of Nietzsche and Rousseau, he sometimes confuses Jim Morrison with Tagore. He has great enthusiasm for rock music, and sometimes he thinks he would be a perfect match in the 60s rock era, but eventually end up with writing on rock music, which he knows best. Sanjay das daydreams too much, piling up unrealistic thoughts.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.