চলোনা ঘুরে আসি অজানাতে,
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে…
‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানের এ দু’টো কলি নস্টালজিক করে তোলেনি, বন্ধু বা প্রিয় সঙ্গীর সাথে সুদূরে পাড়ি জমানোর রোমাঞ্চ জাগায়নি এমন সংগীতপ্রেমী মন বাংলাদেশে হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এমন অনেক চিরসবুজ (evergreen) গান যে মানুষটি বাংলাদেশের সংগীতপ্রেমীদের উপহার দিয়েছেন তিনি লাকী আখান্দ। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সুরকার, সংগীত পরিচালক ও গায়ক তিনি। আধুনিক বাংলা সংগীতের নেপথ্যের এই মহারাজের জীবনের গল্প বলতে গেলে তার সংগীত জীবনের গল্পই বলতে হয়। তা হবে নাই বা কেন? অনেক কম বয়স থেকেই ছোট ভাই হ্যাপি আখান্দ এর হাত ধরে তিনি পথ দেখিয়েছেন বাংলাদেশের আধুনিক ও ব্যান্ডসংগীত জগতকে।
শৈশবের নেশা যখন গান
১৯৫৬ সালের ১৮ জুন পুরান ঢাকার পাতলা খান লেনে এক সংগীত অনুরাগী পরিবারে জন্মগ্রহন করেন সংগীতের এই বরপুত্র। মাত্র ৫ বছর বয়সেই সংগীত বিষয়ে হাতেখড়ি পান বাবার কাছ থেকে। তিনি ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত টেলিভিশন এবং রেডিওতে শিশু শিল্পী হিসেবে সংগীত বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই এইচএমভি পাকিস্তানের সুরকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে রেকর্ড করেন। এরপর ১৬ বছর বয়সে এইচএমভি ভারতের সংগীত পরিচালক হিসেবেও নিজের নাম যুক্ত করেন। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা যোগান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে লাকী আহমেদ ছদ্মনামে গান প্রচার করে।
ভাই হ্যাপি আখান্দের হাত ধরে মাতালেন সত্তর ও আশির দশক
১৯৭৫ সালে লাকী আখান্দ তাঁর ছোট ভাই হ্যাপী আখন্দের একটি অ্যালবামের সংগীতায়োজন করেন। অ্যালবামটিতে ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ ও ‘কে বাঁশি বাজায় রে’ গানে কণ্ঠ দেন হ্যাপী আখন্দ এবং ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে’ ও ‘পাহাড়ি ঝর্ণা’ গানে কণ্ঠ দেন হ্যাপী ও লাকী দুজনে। আখান্দ ১৯৮০ সালে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পরিচালিত ‘ঘুড্ডি’ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন। এই চলচ্চিত্রে হ্যাপী আখন্দের আগের অ্যালবামের ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটি ব্যবহৃত হয়। সুবর্ণা মুস্তাফা এবং রইসুল ইসলাম আসাদের ঠোঁটে (lip-sync) এই গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে সেসময়। ১৯৮৪ সালে সারগামের ব্যানারে প্রকাশ পায় সুরকার, সংগীত পরিচলাক ও শিল্পী লাকী আখন্দের প্রথম একক সেলফ্ টাইটেলড অ্যালবাম ‘লাকী আখন্দ’।
বাংলা সংগীতের ক্ল্যাসিক সেই অ্যালবামের উল্লেখযোগ্য কিছু গান হলোঃ
‘এই নীল মণিহার’, ‘আমায় ডেকো না’, ‘রীতিনীতি কি জানিনা’, ‘মামনিয়া’, ‘আগে যদি জানতাম’, ‘হৃদয় আমার’, ‘সুমনা নামের মেয়েটি’। অবশ্য পরবর্তীতে ‘আমায় ডেকো না’ গানটি তিনি শিল্পী সামিনা চৌধুরীকে উপহার দেন। সত্তর-আশির দশকে সংগীতের আসর জমিয়ে, আধুনিক সুর আর সংগীতায়োজনের ভিন্নধর্মী গানে শ্রোতাদের মন জয় করেছিলেন দুই ভাই হ্যাপি ও লাকী আখান্দ।
এক যুগের জন্য নিলেন স্বেচ্ছা নির্বাসন
১৯৮৭ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে তাঁর সংগীত জগতে বিচরণের আশৈশব সহচর, সংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র হ্যাপি আখন্দের আকস্মিক বিদায়ে থমকে গেলেন তিনি। স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ালেন গান ও গানের জগত থেকে। এক যুগ পরে নতুন করে শ্রোতাদের সামনে উপস্থিত হন। তারপর কখনো গেয়েছেন আবার কখনো গাইয়েছেন। তার ফিরে আসার কথা বলার আগে একটি গল্প বলতে হয়।
গল্পটা খুঁজে পাওয়ার!
১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মত ঢাকায় আসেন ওপার বাংলার জনপ্রিয় শিল্পী অঞ্জন দত্ত। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠানের মাঝে আয়োজকরা তাঁকে জানালেন সেখানে আরো একজন শিল্পী উপস্থিত আছেন। নিছক আসর জমাতে সেই অচেনা শিল্পীকে ডাকলেন মঞ্চে। সাধাসিধে লাকী আখান্দও সে ডাকে সাড়া দিয়ে উঠে এলেন মঞ্চে। কিন্তু কি অদ্ভুত মিল, কেউ কাউকে চেনেননা! কেউ কারো গানও শোনেননি! কিন্তু ঠিকই দুজন মিলে আসর জমিয়ে ফেললেন সেদিন। যেই লাকী আখান্দ দীর্ঘদিন চুপ মেরে বসেছিলেন সেদিনের সেই শো’তে আবার গেয়ে উঠলেন। ক্ষণিকের এই পরিচয়েই এপারের লাকী আখান্দ মুগ্ধ করেছিলেন ওপারের অঞ্জন দত্তকে। যার স্মৃতি অঞ্জন বন্দী করেছেন ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ অ্যালবামের ‘লাকী আখান্দ’ শিরোনামের গানে।
ফিরে আসা
১৯৯৮ সালে ‘পরিচয় কবে হবে’ ও ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ অ্যালবামের সংগীতায়োজনের মাধ্যমে ভক্ত-শ্রোতাদের মাঝে সাড়া জাগিয়ে গানের ভুবনে ফিরে আসেন লাকী আখান্দ। পরিচয় কবে হবে ছিল তাঁর দ্বিতীয় একক অ্যালবাম এবং হ্যাপী আখন্দের একক অ্যালবাম শেষ উপহার-এর রিমেক। বিতৃষ্ণা জীবনে আমার অ্যালবামে লাকী আখান্দের সুরে সেসময়ের ছয়জন জনপ্রিয় শিল্পী- মাহফুজ আনাম জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, হাসান, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, ও সামিনা চৌধুরী কণ্ঠ দেন। এ অ্যালবামটিতে ব্যান্ড ও আধুনিক গানের কালজয়ী-রোমান্টিক এক মেলবন্ধন উপহার দিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি ব্যান্ডদল আর্কের হাসানের গাওয়া ‘হৃদয়ের দুর্দিনে যাচ্ছে খরা’ গানটির সুর করেন যেটি দেখা হবে বন্ধু অ্যালবামে প্রকাশ পায়।
বাংলা গানে এনেছিলেন নতুন ধারা, নতুন সুর
ফোক ফিউশনের সঙ্গে পাশ্চাত্য সুরের মেলবন্ধন তার সৃষ্টির মূল অবলম্বন। বাংলা গানের সুরে হামিং ও শেকারের সফলতম ব্যবহার করেছিলেন লাকী আখান্দ। তার গানে সুর কখনো বানীকে ছাড়িয়ে যায়নি বরং সুরের আশ্রয়ে গানের বাণী আরও হৃদয়স্পর্শী হয়েছে। সফট্-মেলোডি, মেলো-রক, হার্ড-রক যেটাতেই হাত দিয়েছেন সেটাই হয়ে উঠেছে বাংলা সংগীতের একেকটি মাষ্টারপিস। ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা, ‘এই নীল মনিহার, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে, ‘তুমি কি দেখেছো পাহাড়ি ঝর্না, ‘তুমি ডাকলে কাছে আসতাম সেতো জানতেই’ এমন সব গান শ্রোতাদের হৃদয়ে চিরদিনের জন্য ঠাঁই নিয়েছে বানী ও আবহের সঙ্গে।
মায়ের কাছ থেকে পেলেন জীবনের শ্রেষ্ঠ উপার্জন
ঠুমরি’র উপর ছেলের কোনো কাজ নেই, মা এর এমন অনুযোগে নিজেরই লিখে ফেলেন, ‘ভুলতে পারিনি তোমায়, তুমি কে বলোনা’ এবং গীতিকবিতাটিকে ঠুমরি ধাচে সুর করে নিজেই গাইলেন লাকী। চমৎকার সুরারোপের জন্য মুগ্ধ হয়ে মা নুরজাহান বেগমের পুরস্কার হিসাবে ছেলের হতে তুলে দেওয়া দশ হাজার টাকাকেই লাকী আখান্দ জীবনের শ্রেষ্ঠ উপার্জন মনে করতেন।
নক্ষত্রের চিরবিদায়
২০১৫ সালে, কালোত্তীর্ণ সৃষ্টির নেশায় মেতে থাকা এই সংগীত কিংবদন্তীর ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে। দীর্ঘদিন লড়াই এর পর অবশেষে ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল ঢাকার আরমানিটোলায় নিজের বাসায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। যেন তার গানেরই মত অভিমান নিয়ে ‘আমায় ডেকোনা ফেরানো যাবেনা, ফেরারী পাখিরা কুলায়ে ফেরেনা’ বলে তার অগুণতি ভক্তের প্রার্থনাকে ব্যার্থ করে অন্য কোনো জগতে সুরের মায়াজাল ছড়িয়ে দিতে পাড়ি জমালেন এই সংগীত জাদুকর।
Featured Image: MuSophia