চৈতালিতে যাচ্ছিলাম ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও ঢাকার পথে বের হওয়া মাত্র সার্বক্ষনিক সঙ্গী যানজটকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। জায়গাটা বোধহয় ধানমন্ডি কিংবা ঝিগাতলা। হঠাৎ চোখ পড়লো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে থাকা একজনের দিকে। মুখটা পরিচিত কিন্তু কোথায় দেখেছি? নাহ, বেশীক্ষণ ভাবতে হয়নি। বরাবরের মতোই, পর্দায় দেখা কালো পোশাক পরিহিত মানুষটি হেঁটে যাচ্ছেন আর ঠোঁটে লেগে আছে এক ফালি হাসি। প্রিয় গানগুলোর একটি ‘এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে’ যার কণ্ঠে শুনে বড় হওয়া, হেঁটে যাচ্ছেন সেই সায়ান।

পুরো নাম ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। তবে গান দিয়ে পরিচিতি পাওয়া মানুষটি সবখানে সায়ান নামেই পরিচিত। ২০০৮ সালে একুশে টিভিতে এক ফোনো-লাইভ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গানের ভুবনে যাত্রা শুরু তাঁর। কথাকেন্দ্রিক গানগুলো নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্যে সম্পূর্ণ নতুন এক ধারার। আর সে ধারাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিশেষ এক শ্রোতাশ্রেণি। প্রায় ১১ বছরের সংগীত জীবনে সেই শ্রোতাশ্রেণিকে সায়ান উপহার দিয়েছেন মোট তিনটি অ্যালবাম।

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান; Source: TEDxDhaka
  • ২০০৮ এ প্রকাশিত হয় প্রথম গানের অ্যালবাম ‘সায়ানের গান’
  • ২০০৯ এ দ্বৈত অ্যালবাম ‘আবার তাকিয়ে দেখ’ ও ‘স্বপ্ন আমার হাত ধরো’
  • ২০১৭ সালে ঈগল মিউজিক থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর সর্বশেষ গানের অ্যালবাম ‘কিছু বলো’

এছাড়া ‘জাস্ট ওয়াহিদ’ নামে ভাই এরশাদ ওয়াহিদ ও হাবিব ওয়াহিদের সাথে একটি মিশ্র অ্যালবাম প্রকাশ করেন তিনি।

সংগীতে প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও ছোটবেলা থেকে ঘরোয়াভাবে সাংস্কৃতিক বলয়ে বড় হওয়ার সুযোগ সায়ানের জীবন ও মনোজগতে বেশ প্রভাব ফেলে। ১৯৭৬ সালের ২রা সেপ্টেম্বর কানাডার মন্ট্রিলে জন্ম নেয়া সায়ান মাত্র সাত মাস বয়সেই ঢাকায় ফিরে আসেন বাবা-মায়ের সাথে। সায়ানের বাবা মোঃ খসরু ওয়াহিদ আধুনিক বাংলা গানের সাথে যুক্ত ছিলেন। অন্যদিকে সংগীত জগতের সাথে সরাসরি কোন সংযোগ না থাকলেও গানের সাথে মা নাজমা বানুর আত্মিকতার বন্ধন পরবর্তী সময়ে সায়ানকে সংগীতের পথে হাঁটার অনুপ্রেরণা যোগায়। তাঁর পাঁচ বছর বয়সে বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হলেও জীবনকে ইতিবাচকভাবে দেখার ক্ষেত্রে মায়ের অগ্রণী ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সায়ানের চাচা ফেরদৌস ওয়াহিদ ও চাচাতো ভাই হাবিব ওয়াহিদ বাংলাদেশের সংগীত ভুবনে অত্যন্ত সুপরিচিত নাম।

নিজের প্রতিটি গানের লিখা, সুর ও কণ্ঠে নিজেই থাকেন, সায়ান। তাঁর গান লিখার শুরুটা বেশ এক মজার ঘটনা দিয়ে। বয়স তখন ১৪ বছর। বান্ধবীর প্রেমিক ভালো গান লিখতে পারে বলে বান্ধবী দূরে সরে যাচ্ছে এ ভাবনা থেকেই গান লিখার শুরু তাঁর। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে পড়াশোনার জন্যে কানাডার টরেন্টোতে পাড়ি জমালে সেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করেন তিনি। এ সময় গানের প্রশংসার পাশাপাশি অ্যালবাম প্রকাশের জন্যে প্রেরণাও দেয় অনেকে। ২০০১ এ পড়াশোনা শেষ না করেই ফিরে আসেন বাংলাদেশে। ২০০৪ সালে মীর মুবাশ্বির আহমেদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সায়ান। নিঃসন্তান অবস্থাতেই ২০১২ সালে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে তাঁদের।

গান, সায়ানের প্রতিবাদের হাতিয়ার; Source: Studio 19

সায়ানের গানগুলোকে তথাকথিত বাংলাদেশি গানের কোন ধারাতেই যুক্ত করা যায় না। নিজ মনের তাগিদে নিজের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা ও জীবনদর্শন থেকেই সৃষ্টি তাঁর গানের। প্রতিটি গানেই আছে অনুভূতির অনুরণন, আছে গভীরতর ভাবনা। জীবনকে দেখার মধ্য দিয়ে উদ্ভূত এ গানকে তাই বলা যায় ‘জীবনমুখী গান’ বা ‘প্রতিবাদী গান’। তবে যে নামই দেয়া হোক না কেন এ গানের ধারাকে তার সবটাতেই ফুটে উঠবে সায়ানের ব্যক্তিক দর্শন। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সমাজ ব্যবস্থা, মানসিকতা ও সমাজের গোঁড়ামিতে আঘাত করে সে গান।

‘এখানেও সুখ ছিল একদিন’ গানে দেখা যায় সম্পর্কের টানাপোড়নে বিচ্ছেদের সুর। আবার ‘আমি মুসলমানের মেয়ে’ গানে ধর্মের নামে সমাজে চলমান বিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ফুটে ওঠে। নেতাদের কথার ফুলঝুরিতে মিথ্যের আস্ফালন নিয়ে সায়ান গায় ‘ও নেতা ভাই’। আবার বৈষম্যের খেয়ায় ভাসতে থাকা মানুষকে চড়ুই পাখি দেখিয়ে অধিকারের লড়াইয়ে নামার আহ্বানে সে গায় ‘আমার বাসার ঘুলঘুলিতে চড়াই পাখির বাসা’। সায়ানের প্রতিটি গানে থাকে তাঁর মনের যাতনা, দর্শন কিংবা চলমান ঘটনাসমূহকে নিয়ে কোন এক অনুভূতি। তা হোক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে নিয়ে কিংবা নজরুল বড় না রবীন্দ্রনাথ সে অপ্রয়োজনীয় তর্কের উত্তর দিতে।

শুধু গানেই নয়, সায়ানের বাহ্যিকতায়ও রয়েছে সেই ভিন্নতার ছাপ। কালো প্যান্ট শার্টের সাথে ছোট চুলের ছাঁটকে সায়ানের ট্রেডমার্ক বলেই ধরে নেয়া যায়। সেটাকে পুরুষের সমান হতে চাওয়ার বাসনা কিংবা সমাজের সচরাচর কাঠামোকে ভাঙতে ব্যবহৃত প্রতিবাদ হিসেবেই অনেকে মনে করে থাকলেও প্রকৃত অর্থে পোশাক নিয়ে ভেবে সময় অপচয়ে আগ্রহী নন তিনি। তাঁর মতে যা পরিধেয় হিসেবে স্বস্তিদায়ক তা-ই যথেষ্ট।

স্টুডিওতে সায়ান; Source: Facebook

জীবন একদিন ফুরোবেই। আর সেই অনিবার্য মুহূর্ত পাড় করেও যা সায়ানকে মানুষের মনে অবিস্মরণীয় করে রাখবে তা হলো তাঁর কাজ। আর তাই খুব সহজেই নিজেকে ‘কেউ না’ বলে আখ্যায়িত করা সায়ান কর্মজীবনের প্রথম থেকেই বিভিন্ন ধরণের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছেন। সংগীত ও আইনী অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সমাজকে ইতিবাচকভাবে পরিবর্তনের জন্যে যে কাজ তিনি করে চলেছেন তাতে শৈল্পিক সায়ানের সাথে একজন অনুভূতিকেন্দ্রিক সচেতন মানুষকেই পাই আমরা।

Featured Image: shayan.com.bd
This biographical write-up in Bengali is about the singer, song writer and composer Farzana Wahid Shayan whose songs are more of telling stories of life. The references are hyperlinked into the write-up.
Previous articleঢাবিতে গিটার টোন বিষয়ক কর্মশালা
Next articleস্টুডিও বাক্সের আয়োজনে অডিও ইঞ্জিনিয়ারিং কর্মশালা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.