“ বিজ্ঞাপিত অপরাজেয় নই আমি অপরাজেয়
মর্মে মর্মে সত্ত্বায় অনুরনে অপরাজেয় ”
ত্রিদীব ভাইয়ের বিদ্রোহী কণ্ঠ, রিয়াজ ভাইয়ের আগ্রাসী বাজানো, নাদ্ভি ভাইয়ের বেইস, জেহীন ভাইয়ের দ্রুত গিটারে সুর তোলা আর সাথে তামজিদ ভাইয়ের সঙ্গ- খানিক্ষণের জন্যে মনে হলো কোনো এক রণক্ষেত্রে চলে এসেছি; বাজছে অপরাজেয় গানটি। ২০১০ সালের কথা, গভঃ ল্যাবরেটরি স্কুলের রিইউনিয়নে ব্যান্ড মেকানিক্স পারফর্ম করছে। শীতকালে ১০ ডিগ্রি এর মত কম টেম্পারেচারেও উত্তেজনায় আমার গাঁ দিয়ে ঘাম বের হচ্ছে। সবার উচ্ছ্বাস আর কোলাহলে কাজ করছে অন্যরকম এক ভালোলাগা।
আশির দশকের গোঁড়ার দিকে আমাদের দেশের সঙ্গীতে ব্যান্ড বিপ্লব লক্ষ্য করা যায়। হেভিমেটাল ধাঁচের গান এই দেশে প্রথম শুরু করে ব্যান্ড ওয়েভস। সাথে দেখা যায় ওয়ারফেজ, রকস্ট্রাটা এর মত ব্যান্ডগুলো যারা বাংলা গানে নতুন এক মাত্রা যোগ করতে বিশেষ অবদান রাখে। পরবর্তী প্রজন্মের যেসব ব্যান্ড বাংলায় হেভিমেটাল ধাঁচের গান করছে তাদের মধ্যে মেকানিক্স অন্যতম।
এইতো ২০০৬ এর কথা। ত্রিদীব, রুশো, তামজিদ নতুন এক ব্যান্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। একে একে যোগ দেন রিয়াজ ও ইমরান। মেটালিকা, মেগাডেথ, জুডাস প্রিস্ট ছিল তাঁদের টপ ফেভারিট। তাঁদের যাত্রার উল্লেখযোগ্য একটা ঘটনা হল ডি’রকস্টার-২। ২০০৭ সালের এই ব্যান্ড হান্ট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে মেকানিক্সের নাম। তাঁরা অষ্টম স্থানে ছিলেন এবং রিয়াজ হয়েছিলেন সেরা ড্রামার।
উদ্যমী সব গান করে তরুণদের মন জয় করে নেয় মেকানিক্স। এরপর একের পর এক গানের উপহার আমরাপেতে থাকি। ব্যান্ডের লাইন আপে অনেক পরিবর্তন দেখা যায়। ২০০৮ সালের দিকে নতুন সদস্য হিসেবে আসেন জেহীন আহমেদ। পরবর্তী সময়ে রক ২০২ অ্যালবাম এর ধ্রুবস্বর গানের মাধ্যমে আসে আরেক নতুন মোড়। মেকানিক্স তাঁদের অপরাজেয় এ্যালবাম নিয়ে আসে ২০১০ এর দিকে যা ছিল বাংলাদেশের মিউজিকের জন্যে এক কালজয়ী মুহূর্ত।
আমার ২০১০ থেকে মেকানিক্সের কনসার্ট দেখার সৌভাগ্য হয়। প্রত্যেক বার দেখে মনে হত এক নতুন যাত্রা, নতুন অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে জেহীন আহমেদ ছিলেন আমার প্রিয়, তার গিটার বাজানো ছিল অন্য এক মাত্রার।
এবার জেহীন আহমেদকে নিয়ে কিছু বলি, তিনি সাউথ ব্রিজে স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। তাঁর পিতা কিবোর্ডিস্ট মানাম আহমেদ, এ কারণে দেখা যায় ছোট বেলা থেকেই সুরের সাথে এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁর ছোট ভাই জেরিফ আহমেদও একজন অসাধারণ গিটারিস্ট। জেহীনের পচ্ছন্দের তালিকায় ছিল স্তিভ ভাই, সেতরিয়ানি, পল গিলবার্ট, হেন্ড্রিক্স, মেগাডেথ, মেটালিকাসহ আরও অনেকে। তিনি মেকানিক্সে এক অনন্য অংশ হিসেবে যুক্ত হন।
জেহীন আহমেদের কাছে গিটার বাদ্যযন্ত্রের চেয়েও অনেক বেশী কিছু ছিলো। যখন গিটার নিজে গাইতে পারে তখন লিরিক্সের দরকার হয় না। এই গান, এই সুর একটা চেতনা একটা গল্প। “একজন পেইন্টার যখন ছবি আকেন খালি ক্যানভাসে নিজের মনের রঙ, ভাবনাগুলো তুলে ধরেন, গিটারও তেমনই তোমার ক্যানভাস। তুলে ধর তোমার মনের ছবি।” তাঁর এই দর্শন অনুপ্রাণিত করে আমাকে, আমার মত অনেক তরুণকে গিটার হাতে নিতে, এর মাধেমে ছবি আঁকতে।
২০১৭ সালের, ২২ জুলাই আমরা জেহীন কে হারাই। তিনি ফেলে যান অনেক গল্প, স্মৃতি আর কর্ম। তাঁকে প্রায় মনে পরে, যখন গিটার হাতে নেই, যখন মেকানিক্সের গান শুনি, কনসার্টে থাকি। আমার মত হাজার হাজার ভক্ত তাঁর জন্য শুভ কামনা করে যাচ্ছে, যাবে। জেহীন আহমেদ মুছে যাবেন না, সবসময় আমাদের মাঝেই ছিলেন, আছেন, থাকবেন।
আপন মানুষ হারানো খুব সহজ হয় না, ব্যান্ড মেম্বাররা হয় পরিবারের মত। জেহীন কে ছাড়া এখন মেকানিক্সের এক অন্য যাত্রা। তাঁর স্মরনে মেকানিক্স একটি গান বের করেছে ৭ জুন, ২০১৮। গানের নাম নিয়তি, লিখেছেন ত্রিদীব। জেহীনের নিজের তৈরি করা গিটার সোলো এ গানে ব্যবহার করা হয়েছে। সাথে আছে মানাম আহামেদের বাজানো একটি অংশ। গানটির মিউজিক ভিডিও দর্শকরা ইতোমধ্যে দেখেছেন। গানটা শুধু গান নয়, একটি আবেগের জায়গা যা পুরো দেশের ব্যান্ড মিউজিক কমিউনিটিকে অশ্রুসিক্ত করার মত। জেহীন ভাই আপনি যেখানেই আছেন ভালো থাকবেন, আপনার কর্ম অনুপ্রেরণা হিসেবে সামনের দিনেগুলোতে আমাদের মুক্তির পথ দেখাবে। আপনি আমাদের মাঝেই থাকবেন।
– জামান সাকিব
Feature Image: Compiled
Well written Sakib. Zehin bhai will be missed.