যে কজন ব্যক্তিত্ব বাউল সঙ্গীতকে বিশ্বদরবারে নিয়ে গেছেন তাদের মাঝে “দিল কি দয়া হয় না” খ্যাত পবন দাস বাউল অন্যতম। পশ্চিমা পপ সঙ্গীতের সাথে বাউল সঙ্গীতের মিশ্রনে অ্যালবাম প্রকাশ করে বাউল সঙ্গীতকে পুরো বিশ্বের কাছে পৌছে দিয়েছেন তিনি।
১৯৬১ সালের ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার মোহাম্মদপুর নামে ছোট্ট একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন পবন দাস বাউল। গানের প্রতি টান ছোটবেলা থেকেই তার। মা-বোনদের গান গাইতে দেখলেও প্রধান অনুপ্রেরণা ছিলেন তার বাবা দিবাকর দাস। কবিগান ও কীর্তনে পারদর্শী
দিবাকর দাস উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া খুব সামান্য জমিতে চাষবাস করে সংসার চালাতেন। শোনা যায় লাঠিখেলা ও কুস্তিতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। অর্থের প্রাচুর্য না থাকলেও বেশ সুখেই কাটছিলো পবন দাস বাউলের জীবন। কিন্তু তার ছয় বছর থাকা অবস্থায় বাবা দিবাকর দাস অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার খরচ জোটাতে চাষের সামান্য জমিটুকুও বিক্রি করে ফেলতে হয়। তাতেও লাভ হয়নি। সাতজনের সংসার চালানো দুরূহ হয়ে পড়লে উপায়ন্তর না দেখে রোজগারের উদ্দেশ্যে অসুস্থ দিবাকর দাস মাধুকড়ি গান গেয়ে ভিক্ষা করা শুরু করেন। এ সময় পবন দাস বাউল বাবার সাথে থেকে দূরদূরান্তের গ্রাম, মেলা, ট্রেনসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে দোহারি ও নাচ করতেন। পবন দাসের ভাষ্যমতে এ ঘুরে ঘুরে ভিক্ষাই তার ভেতরে বাউল সঙ্গীতের প্রতি এক আকর্ষণ জাগিয়ে তোলে, তাকে গানের তালিম দেয়। প্রাকৃতিকভাবেই গানের প্রতি প্রবল আবেগ তাকে করে তোলে বাউল। সময়ের সাথে সাথে বাউলদের বিভিন্ন মেলায় গান করা শুরু করেন তিনি এবং সুবন দাস বাউল নামে পরিচিতি পান।
কাগজে কলমে যে শিক্ষা তার কিছুই পাননি পবন দাস বাউল। তিনি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। বাবার কাছ থেকে অক্ষরজ্ঞানের হাতেখড়ি বর্ণগুলো চিনে নিয়ে বাকিটা নিজেই শিখে নিয়েছেন। একই ঘটনা প্রযোজ্য তার গান শেখার ক্ষেত্রে। মাত্র ছয় বছর বয়সে এক সূফী ফকিরকে ডুবকি বাজিয়ে গান গাইতে দেখেন তিনি। বাবাকে অনুরোধ করলে ছয়আনা দিয়ে একটি ‘ডুবকি’ কিনে দেন তাকে যার বর্তমান বাজারমূল্য একশ বিশ থেকে দেড়শ টাকা। অন্যদের বাজাতে দেখে একা একাই ডুবকি বাজাতে শেখেন তিনি। দোতরা ও খমোকও বাজানোও শিখেছেন একাই। গানও শিখেছেন একইভাবে নিজ প্রচেষ্টায়। কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি। কিন্তু নিজের মাঝে ধারণ করতে পেরেছেন বলেই বাউল গানকে করেছেন বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বাউল সংস্কৃতিকে মাস্টার পীস অব দ্যা ওরাল এ্যান্ড ইনট্যাঞ্জিবল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি তালিকার অন্তর্ভুক্ত করে।
১৯৭৭ সালে বাউলদের নিয়ে করা “লে চান্তস দেস ফৌ” (যার বাংলা দাঁড়ায় “পাগলের গান”) শীর্ষক ফ্রেঞ্চ প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করা হয় গৌর ক্ষ্যাপা, রমানন্দ ও পবন দাস বাউলকে নিয়ে। তৈরির দু’বছর পর ১৯৭৯ সালে ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচার করা হয় এটি। কার্তিক নামের একটি ছেলেকে কেন্দ্র করে বাউলদের জীবনব্যবস্থা, শুনে শুনে শুধু মৌখিকভাবে তার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এগিয়ে চলা সবই এ প্রামাণ্যচিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়। এটি প্রচারিত হবার পরপরই ১৯৮০ সালে রেডিও ফ্রান্স থেকে প্রায় ১০০০ মানুষের উপস্থিতিতে তাদের নিজস্ব হলে করা কনসার্টে গান পরিবেশনের জন্যে ডাক পান পবন দাস বাউল। তারপর থেকেই ফ্রান্স ও ভারতে যাওয়া আসা করলেও একসময় ফ্রান্সেই স্থায়ী হন তিনি। ১৯৮২ সালে ফ্রান্সের একটি কনসার্টে দর্শনার্থী হয়ে আসা মিমলু সেনের সাথে পবন দাস বাউলের পরিচয় হয় এবং পরবর্তী সময়ে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। জীবনসঙ্গীকে হিন্দি থেকে শুরু করে ইংরেজী ও ফ্রেঞ্চ পড়তে শিখিয়েছেন মিমলু। ১৯৮৮ সালে তার সাথে পরিচয় হয় লন্ডনে জন্ম নেয়া গিটারিস্ট স্যাম মিলেস’র। তাদের যৌথ উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে পিটার গ্যাব্রিলের স্টুডিও রিয়াল ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস থেকে প্রথমবারের মতো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ফিউশনে বের হয় রিয়াল সুগার অ্যালবাম যার ‘দিল কি দয়া হয় না’ গানটি ছুঁয়ে যায় দর্শকের মন। ১৯৯৮ সালে “ইনার নলেজ” ও ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় “টানাটানি” অ্যালবামটি।
বাংলা ১৩৮৫ সালে বন্যায় সকলে যখন জীবন বাঁচিয়ে গ্রামের স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন তখন পবন দাস বাউলের ভাই লিখলেন ‘বসুন্ধরার বুকে’ গানটি আর তাতে কন্ঠ দিলেন বাউল নিজে। ‘দিল কি দয়া হয় না’ গানটি শুনেছিলেন পথ ধরে হেঁটে যাওয়া কোন এক বাউলের মুখে। সারাজীবন গানকে আপন করে নেয়া এ বাউল দেশীয় সংস্কৃতিকে ভিন্নধারায় তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সঙ্গীতেরও যে মেলবন্ধন সম্ভব তা তিনি দেখিয়েছেন নিজে করে। তার এ প্রচেষ্টাই তাকে আজ করে তুলেছে পবন দাস বাউল।
Feature Image Source: rollingstoneindian.com