শিল্পের মধ্য দিয়ে মত প্রকাশের একটি মাধ্যম সংগীত। যুগ যুগ ধরে সংগীত ভাব, আবেগ ও মত প্রকাশের অন্যতম প্রধান বাহন হিসেবে বিবেচ্য। কিন্তু সেই সংগীতকে মাধ্যম করে নিজ মত প্রকাশে যদি বাঁধা দেয়া হয় তাহলে কী করবেন? দেশের শিল্পীদের ও দলগুলোকে বলছি। আপনাদের গানে থাকা প্রতিবাদের কথা, মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে অন্যায় দেখালে যদি সরকার ক্ষুব্ধ হয়ে বেঁকে বসে, আপনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তখন কী করবেন? পুলিশ যদি সকল বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলে, অ্যালবামের সকল কপি গুলি করে নষ্ট করে দেয়, অনুশীলন করার জায়গাটিতে তান্ডব চালায় আর সাথে সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০ বারের মত গ্রেপ্তার করে, তাহলে কী করবেন? তবুও কি করবেন সংগীত চর্চা?
উত্তরটা না হয় নিজের জন্যই তুলে রাখুন। কিন্তু প্রশ্নগুলো শুনে কী একবারও ভাবেননি “গান করার শাস্তি কি এতটাও নির্মম হতে পারে?”
তুরস্কের নাগরিক হলে হয়তো উত্তরটা সহজেই পেয়ে যেতেন। একটু দাঁড়ান। তুরস্ক পর্যন্ত যেতে হবে না। ‘৯০ এর দশকে আমাদের দেশের কথাই ভাবুন নাহয়। ১৯৯৭ সালে মাকসুদ ও ঢাকা ব্যান্ডের অ্যালবাম ‘প্রাপ্ত বয়স্কের নিষিদ্ধ’ ও ১৯৯৯ সালে ‘রবীন্দ্রনাথ-২০১০’ গানের জন্য কোনো অভিযোগ ছাড়াই মাকসুদুল হককে গ্রেপ্তার করে পাশবিকভাবে যে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয় তা কী খুব একটা ভিন্ন কোন দৃশ্য?
শিল্প প্রতিবাদের অহিংস মাধ্যম- হোক সেটা গান, কবিতা, নাটক বা অন্য যেকোনো কিছু। তুরস্কের ফোক-রক ব্যান্ড গ্রুপ ইয়োরামও বেছে নিয়েছিলো প্রতিবাদের এই অহিংস মাধ্যম। কিন্তু প্রতিদানে শিকার হয়েছে সরকারি বাহিনীর হিংস্রতার। তবুও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অহিংস পন্থা অবলম্বন করে গিয়েছেন দলটির অন্যতম সদস্য হেলিন বোলেক। অনশনের ২৮৮ দিন পার করে ৩ এপ্রিল ইস্তাম্বুলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দলের আরেক সদস্য ইব্রাহিম গোকচেকের সঙ্গে অনশন শুরু করেছিলেন হেলিন। তাদের দাবি ছিল ব্যান্ডের ওপর থেকে সকল নিষেধাজ্ঞা ও মামলা প্রত্যাহার এবং কারাবন্দি শিল্পীদের মুক্তি দান। কিন্তু এরদোয়ান সরকার নিজের অবস্থান থেকে নড়েনি একচুলও। শিল্প ও সংস্কৃতিকে গলা চেপে হত্যা করতেতো দ্বিধা করেইনি বরং গতমাসে হেলিন ও ইব্রাহিমের অনশনের বিষয়ে একটি যৌক্তিক সমাধান চাইতে মানবাধিকার কর্মীদের একটি প্রতিনিধিদল তুরস্কের ডেপুটি ইন্টেরিয়র মিনিস্টারের সঙ্গে আলোচনায় বসলে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয় প্রতিবাদ কর্মসূচি প্রত্যাহার করার আগ পর্যন্ত সরকার তাদের কোন প্রকার দাবি মূল্যায়ন করবে না।
হার মানেননি হেলিনও। ২৮৮ দিনের অহিংস যুদ্ধ শেষে পরাজিত হননি তিনি, পরাজিত হতে দেননি সংগীতকে। বরং পরাজিত করেছেন এরদোয়ান সরকারকে। লাখ লাখ মানুষের মনে অবিশ্বাস ও ঘৃণার জন্ম দিয়ে পরাজিত হয়েছে হিংস্রতা আর নৃশংসতা। পৃথিবীর কাছে হেলিন বোলেক হয়ে উঠেছেন আজ প্রতিবাদের প্রতিশব্দ আর ঘৃণার প্রতিশব্দ হয়েছে এরদোয়ান সরকার।
১৯৮০ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পরে দমনমূলক রাজনৈতিক অবস্থার বিরুদ্ধে মানুষকে সোচ্চার করতে গড়ে ওঠে প্রতিবাদী গানের দল গ্রুপ ইয়োরাম। ১৯৮৫ সালে মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থীর হাত ধরে যাত্রা শুরু করে দলটি। তারা চেয়েছিলো তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গানের মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে সকলকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে। তুরস্কে তুমুল জনপ্রিয় এ গানের দল লাতিন আমেরিকান নউভা ক্যানসিওন (Nueva cancion) আন্দোলন ও আদি অ্যানাটোলিয় (Anatolian) সংগীত দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তুর্কি এবং কুর্দি ভাষার সংমিশ্রণে ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিকোণের মাধ্যমে নিজেদের বামপন্থী চিন্তা-চেতনাকে সংগীতে তুলে ধরে। উল্লেখ্য, নউভা ক্যানসিওন এমন এক লাতিন গানের ধারা যা সমাজ সচেতন লিরিক্সের মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলে। ‘৭০ ও ‘৮০-র দশকে পর্তুগাল, স্পেন এবং লাতিন আমেরিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাপূর্ব অবস্থায় এ ধারা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। গ্রুপ ইয়োরামের গানের কথায় উঠে এসেছে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, মানুষের আমেরিকামুখী দৃষ্টিভঙ্গি, তুর্কি সরকারের নীতিমালা, অন্যায়, অত্যাচার, দুর্বল ও দরিদ্রদের শাস্তিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়। দলটি তাদের গানে ঐতিহ্যবাহী তুর্কি বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি অধুনিক বাদ্যযন্ত্রও ব্যবহার করে থাকে। দলটিতে বিভিন্ন সময়ে সদস্য বদল হলেও এর মূল সদস্য ছিল ১৬ জন। এ পর্যন্ত দলটির ২৩টি অ্যালবাম ও এফ-টিপি (F-Tipi) নামে একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ পেয়েছে।
তুরস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া (top selling) অ্যালবাম এ দলেরই। তুরস্কে ১৯৮০ সালে কুর্দিদের ভাষাকে সন্ত্রাসীদের ভাষা আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে কুর্দি শিল্পী ও সমাজকর্মীদের উপর সন্ত্রাসবিরোধী আইনের প্রয়োগ হয়ে আসছে। গ্রুপ ইয়োরাম কুর্দি ভাষায় গান করে বলে তারা হয়ে উঠেছিল কুর্দিদের সংগ্রামের প্রতীক। অর্কেস্ট্রা থেকে শুরু করে ছোট পরিসরে মাত্র কয়েকটি বাদ্যযন্ত্রেও দেখিয়েছেন তাদের পরিবেশনা। পীর সুলতান আবদাল, নিকোলা ভ্যাপ্টসরভ, ভিক্টর জারা, এবং নাজিম হিকমতের মতো যেসকল শিল্পী ও কবি ন্যায়বিচারের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য নিজ কণ্ঠকে উৎসর্গ করেছিলেন তাদের দ্বারা নিজেদের দীক্ষা প্রাপ্ত মনে করে এ দল। গ্রুপ ইয়োরাম ‘তাভির’ নামের একটি পত্রিকাও বের করতো। এতে শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য ও সংগীত বিষয়ক লেখালিখি ও আলোচনা প্রকাশিত হতো। ইস্তাম্বুলের ওকমেডানিতে অবস্থিত ইডিল সংস্কৃতি কেন্দ্র থেকে দলটি তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছিলো।
তিন দশক ধরেই দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা অকপটে ও সাহসিকতার সাথে বলে আসায় দলটি তুরস্কে বেশ জনপ্রিয়। দলের সদস্যরা প্রগতিশীল সমাজকর্মী হিসাবে ’৯০ এর দশক থেকে তুরস্কের বেশিরভাগ প্রধান গণ-বিক্ষোভ, হরতাল এবং কারখানার কর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীতদের দাবি আদায়ে কাজ করেছে। তুরস্কে বিশাল এক ভক্তমহল দেখেই বোঝা যায় দলটির ব্যাপক প্রভাব ও জনপ্রিয়তা। তুরস্কসহ বিশ্বজুড়ে অনলাইনে রয়েছে গ্রুপ ইয়োরামের সংগীতের চাহিদা। এছাড়া সিডি বিক্রয় এবং কনসার্টের উপস্থিতিও সে প্রমাণ বহন করে। ২০১০ সালের ১২ জুন ব্যান্ডটির ২৫তম বার্ষিকীর রজতজয়ন্তী কনসার্ট ইনোনু স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। কনসার্টটিতে ৫৫,০০০ ভক্ত উপস্থিত ছিলো। ২০১১ সালে তাদের সিরিজ কনসার্টের প্রথম দু’টিতে যথাক্রমে ছিলো ১,৫০,০০০ ও ২,৫০,০০০ মানুষের উপস্থিতি।
সরকার গ্রুপ ইয়োরামের সদস্যদের বরাবরই ক্রমাগত চাপ এবং হয়রানির মধ্যে রেখেছে। বিশেষত ২০১৬ সালের জুলাইয়ের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। ব্যান্ড সদস্যরা তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বন্দি দশা, গ্রেপ্তার এবং নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হন। সব মিলিয়ে দলটির সদস্যরা প্রায় ৪০০ বারের মতো গ্রেপ্তার হয়েছে। দলটির কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু ইস্তাম্বুলের ইদিল সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গত তিন বছরে প্রশাসন কমপক্ষে নয়বার অভিযান চালায়। এ সময় ব্যান্ডের বাদ্যযন্ত্রগুলো ভাঙা হয়, ছিঁড়ে ফেলা হয় গানের বইগুলো। ব্যান্ডের এক বিবৃতি অনুসারে পুলিশ এই অভিযানগুলোতে সর্বমোট ৩০ জন ব্যান্ড সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এই হামলার প্রতিবাদে ব্যান্ডের সদস্যরা ২০১২ সালের জুনে অনশন শুরু করেন। এরদোয়ান সরকারের দাবি নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন ডিএইচকেপিসি (DHKP/C) এর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে গ্রুপ ইয়োরামের। তবে এ ব্যাপারে কখনও কোনো ধরনের প্রমাণ দেখাতে পারেনি সরকার।
তুর্কি সরকার সুন্নি হওয়ায় শিয়াদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান। হেলিনের পরিবার শিয়া সম্প্রদায়ের হওয়ায় এবং ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও সাম্যের পক্ষে হেলিনের অবস্থানের জন্য তাঁর শেষকৃত্য তুর্কি সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মৃত্যুর পর দিন হেলিনের শেষকৃত্যের সময় তুর্কি পুলিশ শুধু বাঁধাই দেয়নি, উপরন্তু উপস্থিত ভক্তদের উপর আক্রমণ করে শববাহী গাড়ির চালকসহ অনেককে আটক করে। দ্রুত দাফনকার্য শেষ করতে চাপ সৃষ্টি করে পুলিশ। কবরস্থানে কেবল হেলিনের পরিবার এবং তার আইনজীবীকে উপস্থিত থাকতে দেয়া হয়।
মুসলিম রীতি অনুসারে কবর দেওয়ার আগে মৃত ব্যক্তির দেহকে গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করা হয়। পুলিশ অসম্মানের আরেকটি বড় নজির হলো হেলিনের দেহকে দাফনের আগে শেষবারের মতো গোসলও পর্যন্ত করাতে দেয়নি। পরিবারের সাথে বাক-বিতন্ডার পরও গোসল ছাড়াই মৃতদেহ দ্রুত কবর দিতে বাধ্য করে পুলিশ।
যেদিন হেলিন মারা যান সেদিন বিকেলে তাঁর পরিবারের সাথে ইব্রাহিম ও ভক্তরা কন্ঠ মিলিয়ে গান গেয়ে তাকে সম্মান প্রদর্শন করে। গ্রুপ ইয়োরামের আরেক সদস্য সেহের আদিগুজেল বলেন, “হেলিন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এসব সহ্য করেছে। সে নিজের লোকেদের প্রতি তাঁর ভালবাসা হারায়নি।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের দাবিগুলি বৈধ আর আমরা সেই বৈধতার ভিত্তিতে বিজয় অর্জন করব। আজ হেলিন আমাদের উপর ভরসা করে চোখ বন্ধ করেছেন। আমরা আজ এখানে তাকে কথা দিচ্ছি যে আমরা লড়ে যাবো এবং আমরা আমাদের লড়াইয়ে বিজয়ী হবোই।”
হেলিনের মৃত্য শুধু একজন সংগীত শিল্পীর চলে যাওয়া নয়। তাঁর আমৃত্যু প্রতিবাদ ছিলো সংগীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও সহশিল্পীদের জন্য ভ্রাতৃত্ববোধের অদ্বিতীয় দৃষ্টান্ত। তাঁর প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ, আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতিমনা মানুষের মাঝে।