আগের পর্বের পর…
সংগীত জগৎ ও সমাজসেবায় সমানভাবে কাজ করে যাওয়া এ শিল্পীর ব্যক্তিজীবন অনেকবেশী প্রভাবিত ছিল তার পরিবার দ্বারা। তার বাবা আলবার্ট এক্সরে মাইক্রোস্কোপের সহ-উদ্ভাবক ছিলেন। তাকে অ্যামেরিকা সরকারের পক্ষ থেকে সামরিক কাজে যুক্ত হবার জন্যে প্রস্তাব দেয়া হলে তিনি শিক্ষা ও শান্তিবাদের কথা ভেবে তাতে অস্বীকৃতি জানান। ৮ বছর বয়সে আলবার্টের এক বন্ধু জোয়ানকে একটি উকেলেলে উপহার দেন। এটিতে তিনি ৪টি কর্ড বাজাতে শেখেন। ১৩ বছর বয়সে তিনি ফোক গায়ক পিট সীগারের কনসার্ট দেখে মুগ্ধ হন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি জনসম্মুক্ষে গান গাওয়া শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি তার প্রথম গিবসন অ্যাকুয়াস্টিক গিটার কিনেন। বোস্টন এবং কেমব্রিজের কফিহাউজগুলোতে গান গেয়েই সংগীতজীবন শুরু করেন জোয়ান।
জোয়ান বায়েজের প্রথম প্রেমিক মাইকেল নিউ ছিলেন তার কলেজপড়ুয়া বন্ধু। কিন্তু নিজের অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ও মাইকেলের সাথে সম্পর্কে ভারসাম্যে আনা কঠিন হয়ে পড়েছিল জোয়ানের জন্যে। একদিন পথের পাশে প্রেমিককে অন্য নারীর সাথে চুম্বনরত অবস্থায় দেখার পরও সম্পর্ক ভাঙেননি তিনি। বেশ কিছু বছর পর ক্যালিফোর্নিয়ায় স্থানান্তরিত হবার পর একসাথে থাকা কঠিন হয়ে পড়লে দুজনের সম্পর্ক ভেঙে যায়। ১৯৭৯ সালে মাইকেল নামে একটি গান লিখে তাকে উৎসর্গ করেন জোয়ান।

১৯৬১ সালে জোয়ানের পরিচয় হয় বব ডিলানের সাথে। তখন অবশ্য ডিলানের তারকাখ্যাতি ছিল না। একদিকে জোয়ান “লোকজ সঙ্গীতের সম্রাজ্ঞী” নামে পরিচিত অন্যদিকে ডিলান এ জগতে নতুন। কথিত আছে প্রথমে জোয়ানের ছোটবোন মিমির প্রতিই আগ্রহ ছিল ডিলানের। কিন্তু দুজনের একসাথে কাজ ও চলাফেরায় গণমাধ্যমে তাদের দুজনের কথা ফলাও করে প্রচারিত হলে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তারা। কিন্তু সে সম্পর্কও টেকেনি। পরবর্তী সময়ে তাদের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল এবং একসাথে একাধিক কাজও করেছেন তারা। তবে গানকে প্রতিবাদের ভাষা ও সমসাময়িক প্রসঙ্গ তুলে ধরার মাধ্যম হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে জোয়ানকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন বব ডিলান। তাদের পরিচয়ের পূর্বে জোয়ানের সাময়িক বিষয় নিয়ে গান ছিল অত্যন্ত সীমিত। এ সম্পর্কে জোয়ান বলেন- “The really, really good stuff comes from down deep.”
বব ডিলানের সাথে সম্পর্ক ও সম্পর্কের টানোপোড়ন নিয়ে ডোন্ট লুক ব্যাক, এ ভয়েস টু সিং উইথসহ একাধিক প্রামান্যচিত্রে কথা বলেন তিনি। নিজে উপস্থিত থেকে নোবেল কেন গ্রহন করেননি বব এমন প্রশ্নের জবাবে এক সাক্ষাৎকারে জোয়ান বলেন- “I think he’s shy. But I don’t really know. I have just enough sense to know that I won’t understand him.”
১৯৬৭ সালে মিলিটারীতে কাজ করতে অনিচ্ছুকদের পক্ষ নিয়ে অবরোধ করলে জোয়ান ও তার মা সহ আরো ৭০ জন মহিলাকে সান্তা রিটা জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানেই জোয়ানের সাথে ডেভিড হ্যারিসের পরিচয় হয়। পরিচয়ের মাত্র ৩ মাসের মাথায় তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জোয়ান ও ডেভিডের ঘরে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। পূর্বের সেই ঘটনার জের ধরে ডেভিড প্রায় পনেরো মাস জেল খাটেন। এ সময় “আ সং ফর ডেভিড”, “মিথস” ও “ফিফটিন মান্থস” নামে গান লেখেন জোয়ান। কিন্তু জেল থেকে বেড়িয়ে সম্পর্কের তিক্ততা বেড়ে গেলে সম্পর্কচ্ছেদ করেন তারা। এ সময়ে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে নিজের আত্মজীবনীতে তিনি লেখেন- “I am made to live alone” অর্থাৎ “আমি তৈরিই হয়েছি একা থাকার জন্যে”।

১৯৮০ সালের দিকে এপোলোর প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন জোয়ান। কিন্তু সে সম্পর্ককে বিবাহের মাধ্যমে পরিপূর্ণ রূপ দিতে রাজী ছিলেন না তিনি। ২০০৮ সালে স্টিভের মৃত্যুর পর জোয়ান এক সাক্ষাৎকারে সম্পর্ক ভেঙে যাবার পরও তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে থাকার কথা জানান।
বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যক্তিজীবনের বন্ধুর পথ পাড়ি দিলেও জোয়ান মানবতার সেবায় ছিলেন সবসময়ই সোচ্চার। ১৯৭০ এর শেষের দিকে তিনি নিজের মানবাধিকার সংস্থা গড়ে তোলেন যার মূল লক্ষ্য ছিল অত্যাচার-নিপীড়নের বিপক্ষে প্রতিবাদ করা ও সকল পক্ষকে সমানভাবে সমালোচনা করা। সক্রিয় অংশগ্রহনের কারণে তাকে ১৯৭৬ সালে থমাস মার্টন এওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। ২০০৬ সালের ২৭ জুলাই লিগ্যাল কমিউনিটি এগেইন্সট ভায়োলেন্সের পক্ষ থেকে জোয়ানকে ডিস্টিংগুইশড লিডারশীপ এওয়ার্ড প্রদান করা হয়। সকল ধরনের সহিংসতার বিপক্ষে কাজ করায় তাকে এ আজীবন সম্মাননা দেয়া হয়। ২০০৭ সালে তিনি গ্র্যামির পক্ষ থেকে আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন। নিজের কাজের পুরস্কারস্বরুপ ২০১১ সালে জোয়ানকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে সম্মাননা জানানো হয় এবং মানবতার সেবায় উৎসর্গ শিল্প ব্যক্তিত্বদের জন্যে জোয়ান বায়াজ এওয়ার্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১৫ সালে তাকে এম্বাসেডর অব কনসাইন্স এওয়ার্ড দেয়া হয়। ২০১৭ সালের ৭ এপ্রিল জোয়ানকে “রক এন্ড রোল হল অব ফেইম” এ যুক্ত করার মাধ্যমে সম্মান জানানো হয়।
জোয়ান বায়েজ তার পুরো জীবন কাজ করেছেন মানুষের অধিকার রক্ষায়। এর কোন গন্ডি তিনি টানেননি। সমকামীদের অধিকার থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রত্যাহার, পরিবেশ রক্ষা, প্রাণীদের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ কিংবা যুদ্ধ বন্ধের জন্যে করা আন্দোলনের কোনটাই বাদ দেননি তিনি। অহিংস পৃথিবী প্রতিষ্ঠায় সারাজীবন কাজ করে গেছেন তিনি। তার গানে বরাবরই ফুটে উঠেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ন্যায়ের পক্ষে শক্ত অবস্থান। জোয়ান বায়েজের মত শিল্পীরাই পারবে শিল্পকে একই সাথে শিল্পের উন্নয়ন ও মানবতার কল্যানে কাজে লাগিয়ে সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে।
– তানহা তাসনিম