যারা রক মিউজিক শোনেন বা এ ব্যাপারে মোটামুটি জ্ঞান রাখেন তাদের কাছে খুবই পরিচিত একটি নাম হলো পিঙ্ক ফ্লয়েড (Pink Floyd)। সত্তর-আশির দশকে পশ্চিমা রক সংগীতের জগতে যে ব্যান্ডগুলো রাজত্ব করেছে তার মাঝে পিঙ্ক ফ্লয়েড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাইকেডেলিক রক বা প্রোগ্রেসিভ রক যে ক’টি ব্যান্ডের হাত ধরে শুরু হয় তার মধ্যে পিঙ্ক ফ্লয়েড অন্যতম। ব্যান্ডটির পথচলা শুরু হয় সিড বেরেট এর হাত ধরে। সিড বেরেট, রজার ওয়াটার্স, নিক মেসন এবং রিচার্ড রাইটস এই চারজন মিলে ব্যান্ডটির শুরু করেন এবং কিছুদিন পর ডেভিড গিলমোর যোগ দেন লিড গিটারিস্ট হিসেবে। পরবর্তী সময়ে সিড বেরেট হতাশা, মাদকাসক্তি এবং মানসিক রোগের কারণে ব্যান্ড থেকে সরে যান। এ যাবৎ ব্যান্ডটি ১৫ টি স্টুডিও অ্যালবাম বের করেছে। এর মধ্যে একটি অ্যালবাম এনিমেলস্ (Animals)। এটি কে কেন্দ্র করে এ ফিচারটি লেখা হয়েছে।
এনিমেলস্ পিঙ্ক ফ্লয়েড এর দশম স্টুডিও অ্যালবাম। ১৯৭৭ সালের ২৩শে জানুয়ারী অ্যালবামটি প্রকাশিত হয়। এনিমেলস্ অ্যালবামটি পুরোপুরি আর্থ-সামাজিক, মনস্ত্বাতিক এবং রাজনৈতিক ধারনাকে কেন্দ্র করে লেখা হয়। অভিমানের প্রতিচ্ছবি এঁকে অ্যালবামের প্রথম গানটির শুরু হয় এবং শেষ হয় আশার আলোক দেখিয়ে। এর মাঝখানে রচিত তিনটি গানই (Dogs, Pigs, Sheep) মূলত সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত। বলা হয়ে থাকে ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল রচিত উপন্যাস এনিমেল ফার্ম এই অ্যালবামটি রচনার পেছনে প্রেরণা যুগিয়েছে। রজার ওয়াটার্সকে অনেকে অরওয়েলিয়ান বলেও ডেকে থাকেন। আপনারা যারা সাহিত্য পড়েন তাঁরা নিশ্চয় জেনে থাকবেন অরওয়েল মূলত একজন রাজনৈতিক লেখক। তাঁর রচিত ২ টি বিখ্যাত বই 1984 এবং এনিমেল ফার্ম রাজনীতির নোংরামির এবং রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের দিকটিই তুলে ধরে।

এবার আসি গানগুলোর পর্যালোচনায়:
পিগস অন দ্য উইং (Pigs on the wing: Part One): এ গানটি নিয়ে বলা হয় ওয়াটার্স তাঁর স্ত্রীর সাথে মান-অভিমানের কোন এক সময়ে গানটির রচনা করেন। ১:২৫ মিনিটের গানটিতে ওয়াটার্স শুধু অ্যাক্যুস্টিক গিটার রিদমেই গেয়ে যান। অবশ্য পরে আট ট্র্যাকের যে ভার্সনটা বেরিয়েছে সেখানে একটি গিটার সোলো বাজিয়েছেন গিটারিস্ট স্নো হোয়াইট। গানটিতে ওয়াটার্স লিখেছেন মান অভিমানের কথা। এ গানের দুটি অংশই আলবামটির অন্য গানগুলো থেকে একদম ভিন্ন। মানবিক যে বোধগুলো আমাদের ভেতর আছে সেগুলোর অভাবে আমাদের জীবন কতটা একঘেয়ে এবং কষ্টের হতে পারে তাই গানটির কথার মাধ্যমে বুঝিয়েছেন ওয়াটার্স।
ডগস্ (Dogs): গানটি প্রথমে রচিত হয়েছিলো ‘ইউ’ভ গটা বি ক্রেইজি’ (You’ve Gotta Be Crazy) গানে সাধারণ জ্যামিং পার্ট হিসেবে। পরবর্তী সময়ে এটিকে ‘ডগস্’ (Dogs) নাম দিয়ে একাধিক অংশবিশিষ্ট গানের রূপ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এটি পিঙ্ক ফ্লয়েডের দীর্ঘতম গানগুলোর একটি (একোস এবং অ্যাটোম হার্ট মাদার-এর পরে)। প্রায় ১৭ মিনিট দীর্ঘ এ গানটি এক অনবদ্য সৃষ্টি যা কিনা একবারের জন্যেও বিরক্তির উদ্রেক করে না। গানটি মূলত প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় মানুষের অবসাদগ্রস্থ জীবন নিয়ে রচিত। এখানে একটা কথা বলে রাখা আবশ্যক যে অ্যালবামটির গানগুলো যখন রচিত হয় তখন যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মত ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রে নব্য উদারবাদের জয়জয়কার। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে এমন সব অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা হয় যা বিত্তশালীদের জন্য ভালো এবং সাধারণ মানুষগুলোর জন্য খারাপ ফলাফল বয়ে নিয়ে আসছিলো। অর্থের বন্টন এভাবে হচ্ছিলো যে অসাম্য ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছিলো এবং সাধারণ মানুষের জীবন অর্থের অভাবে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিলো। প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা মানুষের জীবন এমনভাবে দখল করে বসেছিলো যে পুঁজিবাদী কর্পোরেশন এবং কর্পোরেট জীবনধারা মানুষের জীবন পিষে সব রস শুষে বের করে নিচ্ছিলো, নিজস্বতাবোধ বলতে কিছুই বাকি থাকছিলো না। যে যেভাবে পারছিলো টাকা-সুনাম কুড়নোর মোহে জর্জরিত ছিল, তা যেকোনো উপায়েই হোক না কেন। অনেকটা Survival Of The Fittest এর মতো। গানটির এক অংশে তাই এই কথাটিও বলা হয়েছে (ভাবার্থে)। গানটির পুরো অংশ জুড়ে কিভাবে কর্পোরেট কুকুরগুলো মাংসের (টাকা) নেশায় সারাক্ষন প্রতিযোগিতা করে, একে অপরকে পেছন থেকে ছুরি মারে, সর্বক্ষণ আতঙ্কে থাকে নিজে প্রতারিত হবার ভয়ে এবং সবশেষে জীবনের শেষদিনগুলোতে নিজের কর্মফল হিসেবে হতাশা এবং অবিশ্বাসের সাগরে ডুবে যায়। গানটিতে গিলমোরের গিটারের সোলোটি গানটির মূল কথাটিই সুরে বের করেছেন। গানটি নিয়ে গিলমোর বলেছেন,
“রজার যখন প্রথম ডগস্ গানটি লিখেছিলো তখন এর শিরোনাম ছিলো ইউ’ভ গটা বি ক্রেইজি (You’ve Gotta Be Crazy) । তখন এটিতে শব্দের সংখ্যা ছিলো অনেক বেশি। তবে এর অধিকাংশ ভাবই এমন ছিলো যে সেগুলো আমার ভালো লেগেছিলো এবং আমার অনেক চিন্তা-ভাবনার সার-সংক্ষেপই এগুলোর মাঝে ছিলো।”

পিগস্ (Pigs: Three different ones): ডগস্ গানটিতে ওয়াটার্স অর্থলোভে অন্ধ মানুষদের ইঙ্গিতের পর আঙ্গুল তোলেন রাজনীতিবিতদের প্রতি এবং তাদের ভণ্ডামির প্রতি। পিগস গানটির পেছনে ওয়াটার্স অরওয়েলের এনিমেল ফার্ম বইটির অনুকল্প ব্যবহার করেছেন। গানটিতে তিনি যে তিনিটি শুয়োরের কথা উল্লেখ করেছেন তাদের প্রথমজন স্পষ্ট করে না বললেও অনেকে মনে করেন জেমস ক্যালাহানের (James Callaghan) কথাই বলেছেন। আর ২ জন ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গরেট থ্যাচার (যার নামে কিনা তখনকার ব্রিটিশ অর্থনীতিকে বলা হত থ্যাচারোনোমিক্স; ইংরেজিতে Thacheronomics) এবং তৎকালীন ব্রিটিশ সামাজিক কর্মী এবং রক্ষণশীল চিন্তার পৃষ্ঠপোষক মেরি হোয়াইটহাউস। এই হোয়াইটহাউস ছিলেন গোঁড়া রক্ষণশীল এবং তিনি মিডিয়ার স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করেন। তিনি মিডিয়াতে ক্রিকেট ছাড়া অন্য সবকিছুই (যেমন- যৌনতা ,উচ্ছৃংখলতা) সেন্সর করেন। আর লৌহমানবী বলে পরিচিত থ্যাচার তার রাজনৈতিক নীতির কারনে ফকল্যান্ড যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। তার সময়ে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্য, মূল্যস্ফীতি, আন্দোলন সবকিছুই ওয়াটার্সের অপছন্দ ছিল। তার সময়ে মুনাফার স্বার্থে অনেক সেবা ব্যবস্থা জাতীয়করণ থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চালিত হয় যা কিনা সাধারন মানুষের ভোগান্তি বারিয়ে দেয়। এনিমেল ফার্ম-এ অরওয়েল স্ট্যালিন এর সময়কালে কম্যুনিস্ট রাজনৈতিক নেতাদের দিকে করা ইঙ্গিতকে ওয়ার্টাস নিয়ে ব্যবহার করেছেন তৎকালীন ইংল্যান্ডের পুজিবাদী রাজনৈতিক অবস্থা বোঝাতে। পুরো গানটি জুড়েই তিনি রাজনীতিবিদদের ভণ্ডামির ইঙ্গিত করেন এবং তাদেরকে জোকার হিসেবে অভিহিত করেন।

শিপ (Sheep): ওয়ার্টাস গানটি লিখেছেন অন্ধ অনুসারীদের উদ্দেশ্য করে যারা নিজেরা কোন কিছু করতে পারে না, নিজেদের বুদ্ধি ও বিবেক নেই; উপরের নেতাদের কথাই যাদের শেষ কথা। আবার গানটিতে ওয়ার্টাস অরওয়েল এর অনুকল্পও তুলে এনেছেন। তিনি হয়ত গানটিতে সেইসব সৈন্যদের ইঙ্গিত করেছেন যারা কিনা তাদের উপরের কর্মকর্তাদের কথায় যুদ্ধ করে, নিজের বিবেকবুদ্ধি ব্যবহার করে না। এখানে একটা মজার জিনিস বলি, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অন্তরার মাঝখানে ওয়ার্টাস বিবলিকান চরিত্র (বাইবেল এর চরিত্র গুলকে বিবলিকান চরিত্র বলে) টেনে আনেন এবং সেটা পরিবর্তিত করে ব্যংগাত্মকভাবে প্রকাশ করেন। মূলত তিনি Psalm 23:1 ( বাংলা উচ্চরণ সাম ) থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে সেটা ব্যঙ্গাত্মকভাবে পরিবর্তন করে দেন। ওয়ার্টাস যে কত বড় মাপের একজন লিরিসিস্ট, এটা তার কিঞ্চিত প্রমাণ বহন করে। বলে রাখি, Psalm একটি গ্রন্থ যেখানে আমরা কিভাবে ঈশ্বরকে অনুসরণ করব এবং তিনি আমাদের চালনা করলে মঙ্গল হবে সেই কথা বলা আছে। গানটির শেষে দেখা যায় Sheep গুলো একত্র হয়ে Dogs গুলোকে হটিয়ে দেয় এবং নিজেরা ক্ষমতায় আসে। কিন্তু এতদিন যারা(Sheep) নিষ্পেষিত হয়ে এসেছে ক্ষমতার দ্বারা তারাই ক্ষমতায় এসে তাদের পূর্বসূরিদের অনুসরন করে দমন করার জন্য।
Have you heard the news?
The dogs are dead!
You better stay home
And do as you’re told
Get out of the road if you want to grow old
গানটির শেষে ওয়াটার্স এটিই বুঝিয়েছেন যে এই ক্ষমতার পালাবদল একটি চক্রাকার বিষয়। আপাতদৃষ্টিতে বদলালেও আসলে কিছুই বদলায় না।
পিগস্ অন দ্য উইং (Pigs on the wing: Part two) : গানটি অ্যালবামের শেষ গান। গানটির শেষ কথায় তিনি বলেছেন Dogs দের মত সারাক্ষণ প্রতিযোগীতা, Pigs এর মত ভন্ড রাজনৈতিক নেতাদের শোষণ এবং জীবনের শেষপ্রান্তে হতাশাগ্রস্ত হয়ে মরে যাওয়া থেকে কেবল ভালবাসাই বাঁচাতে পারে মানুষকে।

অনেকেই আলবামটি পছন্দ করেননি এর লম্বা গান আর শুধু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা লিরিক্স এর জন্য। অনেকে এই গানগুলোকে ডাইনোসর রকও বলেছিল। কিন্ত সবশেষে পাঠকদের প্রতি একটি প্রশ্ন, গানগুলো আমাদের বর্তমান সমাজের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয় কি? উত্তরটা ভেবে দেখবেন।
Featured Image: consequenceofsound.net