কিছু মানুষ গানের নির্দিষ্ট ধারায় গেয়ে পরিচিতি পায়। কেউবা আবার নিজের রচনাভঙ্গিতে সৃষ্টি করে গানের নতুন ধারা। মৌসুমি ভৌমিক তাদেরই একজন। সচরাচর সঙ্গীতের বিপরীতে হেঁটে সম্পূর্ণ নতুন এক ধারার সাথে শ্রোতাকে পরিচয় করিয়েছেন তিনি। এ ধারায় মানুষের আবেগের চেয়ে আবেগের ভেতরের কথা আর ব্যাথাকে প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। জনপ্রিয়তা পাওয়া কিংবা ব্যবসায়িক সাফল্য কখনোই উদ্দেশ্য ছিল না মৌসুমি ভৌমিকের। তাইতো সংগীত জগতে ২৭ বছর থাকার পরও ২০১৭ এ নতুন প্রকাশিত “সংস ফ্রম টোয়েন্টিসিক্স-এইচ” (Songs from 26H) শীর্ষক অ্যালবামসহ সর্বমোট অ্যালবামের সংখ্যা চার।

মৌসুমি ভৌমিক
মৌসুমি ভৌমিক; © সাইয়িন আজাদ

ভারতীয় বাঙালী এ সংগীতশিল্পী ও গীতিকারের জন্ম ১৯৬৪ সালে ভারতের জলপাইগুড়িতে। বেড়ে ওঠেন উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়ের শিলং এ। মৌসুমি ভৌমিকের পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল বাংলাদেশের পাবনা ও বরিশালে। কিন্তু দেশভাগের পূর্বেই পারিবারিক কর্মসূত্রে ভারতে স্থিত হওয়ায় বাংলাদেশের সাথে কখনোই আবেগীয় সম্পর্ক ছিল না এ শিল্পীর। তার স্বামী নাজেস আফরোজ বিবিসি ওয়ার্ল্ড রেডিও সার্ভিসের লন্ডনভিত্তিক সংবাদদাতা হিসেবে নিযুক্ত আছেন।

মৌসুমি ভৌমিকের গানের জন্ম তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে। সকল স্থানে নিজেকে বৃত্তের বাইরের একজন বলে আবিষ্কারই ব্রত করেছে তাকে এ সংগীত রচনায়। ১৯৯৪ সালে তার প্রথম অ্যালবাম “তুমি চিল হও” প্রকাশিত হয়। এরপর ২০০০ সালে “এখনো গল্প লেখো” ও ২০০১ সালে “আমি ঘর বাহির করি” অ্যালবাম দুটি প্রকাশিত হয়। এর মাঝে “এখনো গল্প লেখো” অ্যালবামে তার নিজের লেখা, সুর করা ও গাওয়া ‘স্বপ্ন দেখবো বলে’ গানটি বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এছাড়াও বিভিন্ন আর্ট ফিল্ম ও প্রামান্যচিত্রের সংগীত আয়োজক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। এর মাঝে তারেক মাসুদের মুক্তির কথা চলচ্চিত্রের “সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড” এবং মাটির ময়না চলচ্চিত্রের গানসমূহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মাটির ময়না চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ সংগীত ক্যাটাগোরি-তে ২০০৩ সালে পাকিস্তানের করাচীতে কারা চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কাত পায়। চলচ্চিত্র উৎসবটি করাচী ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেসটিভল নামেও পরিচিত।

তারেক মাসুদের সাথে মৌসুমি ভৌমিক; Source: Facebook

নিয়মের জালে বাঁধা পড়তে বরাবরই অনিচ্ছুক মৌসুমি ভৌমিক। তার গানকে একবাক্যে আধুনিকের দলে ফেলতে কখনোই রাজী নন তিনি। এমনকি সকলের জীবনের সাথে সংযোগের জায়গা থেকে একে জীবনমুখী গান বলতেও তার আপত্তি। বরং গানগুলোকে মৌসুমি ভৌমিকের নামেই জানুক সবাই এই তার ইচ্ছে। তার গানগুলোর মাঝে থাকে এক ধরণের একাকীত্বের বেদনা, বিরহ যেন থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে। এর থেকে মুক্তির জন্যে তিনি গেয়ে যান- ‘কোথায় শান্তি পাবো কোথায় গিয়ে’। নিজের অনুভূতিগুলোকে সুন্দর এক গাঁথুনিতে সাজিয়ে নেন তিনি। শব্দের গভীরতা তাকে পৌছে দেয় মানুষের অন্তরে। নিতান্ত অচেনা বা অপরিচিত কারো বুকেও যেন গেঁথে যায় সে অনুভূতি। কেননা বিচ্ছিন্ন এ জগতে নিজেকে যুক্ত করতে পারার মাধ্যম হয়ে যায় এ গান।

আড্ডার ফাঁকে রেহনুমা আহমেদ, ডিলারা বেগম জলি, মির্জা তাসলিমা সুলতানা ও মৌসুমি ভৌমিক (বাম দিক থেকে); Source: Facebook

বিংশ শতকের শেষের দিকে যখন প্রজন্ম বিশ্বায়নের আবডালে নিজের সংস্কৃতির আর নিজের ভাষার গানকে হারিয়ে ফেলছিল, যখন নিজ ভাষাকে আপন করতে পুরনো দিনের গানগুলোই হচ্ছিল একমাত্র উপায় তখন শ্রোতাকে নিজ ঘরে ফেরালেন যে কজন শিল্পী মৌসুমি ভৌমিক তাদের মাঝে অন্যতম। নিতান্তই নিজ মনের অনুভূতিকে দিলেন সংগীতের রূপ। সংগীত বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শূন্যের কোঠায় থাকা এক শিল্পী হয়ে গেলেন শ্রোতাকে বাংলা গানে ফিরিয়ে আনার পথিকৃৎ। কিন্তু নিজের কাজকে কখনোই জনপ্রিয়তার শ্রোতে হারাতে দেননি। “দুহাতে কখনোই লিখা আসে না”, এ কথা অকপটে স্বীকার করে যেন মনে করিয়ে দেন প্রমথ চৌধুরীর কথা নিজ সুখে তিনি সৃষ্টি করে যান, বাজারে কাটতির জন্যে না।

পারাপার ব্যান্ডের সাথে মৌসুমি ভৌমিক; Source: Facebook

বাংলাদেশ এবং লন্ডনের শিল্পীদের সমন্বয়ে ২০০২ সালে পারাপার নামক একটি গানের দল গঠন করেন তিনি। দলটির নামই তার ভাবার্থ প্রকাশ করে। মূলত দুই দেশের সংগীতের পারাপারের মাধ্যমে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন করাই এ দল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য। বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে গিটার পরিচালনায় আছেন অলিভার উঈকস, চেলোয় রস অ্যাকশন, ডাবল বেসে বেন হিলিয়ার্ড, দোতারায় সাত্যকি ব্যানার্জী ও ড্রামসে ডেরেক স্ক্রাল। গানের জন্যে বাদ্যযন্ত্রের ওপর যে নির্ভরতা তার খানিকটাই চোখে পড়ে মৌসুমি ভৌমিকের ক্ষেত্রে। সেখানে বিদেশী বাদ্যে বাঙালী গানের যে মোহনীয়তা প্রকাশ পায় তাতেই দেখা যায় পারাপারের সার্থকতা। ভারতছাড়াও বাংলাদেশ ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে গান গেয়েছেন তিনি।

কোন মহৎ কাজের উদ্দেশ্যে না বরং নিতান্তই শখের বশে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও উৎসাহ থেকে লোকজ সংগীতের সংগ্রহ শুরু করেন মৌসুমি ভৌমিক। লোকজ সংগীতের সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ এ সম্পদ নিয়ে আগ্রহ থেকে এগুলোকে ২০০৩ সালে রেকর্ডিং ও প্রামান্যচিত্রে ধারণের প্রচেষ্টা চালান তিনি। এরপর নিজ থেকেই এর সাথে যুক্ত হন সাউন্ড রেকর্ডিস্ট সুকান্ত মজুমদার। বলা যায় তাদের গোটা সাংগীতিক প্রকল্পের যাত্রাগল্পটা ধারন করেছে “দি ট্র্যাভেলিং আর্কাইভ”। গান লেখার পাশাপাশি সংগীত নিয়ে কিছু করার আকাঙ্ক্ষাই একে দশক পেরিয়ে নিয়ে এসেছে এতটা পথ। ২০১১ সালে দি ট্র্যাভেলিং আর্কাইভ ওয়েবসাইট চালু করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের কাজকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। তার কাজের বড় দুটি ক্ষেত্র হচ্ছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম এবং বাংলাদেশের ফরিদপুর ও সিলেট।

mousumi bhowmik in a performance
একটি অনু্ষ্ঠানে মৌসুমি ভৌমিক © Subinoy Das

সংগীতকে স্বভাবের অংশ বলে দাবি করা এ শিল্পীর কাজকে অনেক সময় দেখা যায় কবিতার সাথে তুলনা করতে, যদিও তা ভাবতে বরাবরই আপত্তি মৌসুমি ভৌমিকের। তবুও তার গান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কবিতা লেখার কথা বলেছেন কেতকী কুশারী ডাইসন। বব ডিলানের গানকে কবিতায় শ্রেণীকরণ করে নোবেল দেয়া নিয়ে যেমন তর্ক আছে হয়ত তেমনই থাকবে মৌসুমি ভৌমিককে নিয়েও। তবু তার গানের যে মৌলিকত্ব তাকে মানুষের সাথে সংযুক্ত করতে পেরেছে সে গুনই তার কাজের জন্যে অপেক্ষায় রাখে শ্রোতাদের।

Feature Image Source: Facebook

Previous articleমেকানিক্স ও জেহীন
Next articleরক-ও-ফোন: টিএসসিতে মান্দি উন্মাদনা

1 COMMENT

  1. আমার তোলা ছবি দেখে নিজের কাছে ভালো লাগছে.. এতো মাস পর আজকে দেখলাম এটা.. ❤❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.