বর্তমানে বাংলাদেশে শুরু হতে চলা একটি রিয়েলিটি শো সানসিল্ক ডিভাস (Sunsilk Divas), যার স্লোগান “Explore your music talent and be a member of country’s first all-girl pop band”। এটি মূলত একটি প্রতিযোগিতা যেখানে বিচারকদের রায়ে ৪ জন নারী গায়িকা নির্বাচন করা হবে এবং বিজয়ীদের নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম নারী পপ ব্যান্ড গঠন করা হবে। উদ্যোগটি ভাল হলেও এক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে আলোকপাত না করলেই নয়।
শুরুতেই আসা যাক তাদের প্রথম উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যান্ড গঠন করা প্রসঙ্গে। এখানে কথা হল বাংলাদেশে এই শো-এর আগেও নারী ব্যান্ড (আর হ্যাঁ, সে ব্যান্ডগুলোর সব সদস্যই নারী) ছিল। ৭০ এর দশকে দ্য থ্রি হক সিসটারস (The Three Huq Sisters) নামে একটা ব্যান্ড ছিল যার ড্রামার ছিলেন জর্জিনা হক। তাঁর অন্য দু’জন ব্যান্ডমেট ছিলেন তার বোন সুলতানা হক এবং রোক্সানা হক। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্র শেখ কামালের ব্যান্ড স্পন্দন এর-ও ড্রামার ছিলেন। তিনি দীর্ঘ ৪৪ বছর পর ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আবার ড্রামস বাজিয়েছিলেন। ওইদিন দশর্ক সারিতে দাড়িয়ে তার বাজানো দেখেছিলাম আমিও। এটা গেল ‘৭০ দশকের কথা। এরপর ‘৯০ এর দশকে আসে আরেকটি নারী ব্যান্ড ব্লু বার্ডস (Blue Birds)। ‘সৈকতে একদিন’ নামে তাদের একটি অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এফ মাইনর (F Minor) এবং ক্রেমলিন (Kremlin) নামে দুটি ব্যান্ড গঠিত হয়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে ব্যান্ডটি গঠন হবে তা কোনোভাবেই বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যান্ড হওয়া সম্ভব না।
এরপর আসা যাক এ প্রতিযোগিায় অংশগ্রহনের শর্তের দিকটায়। এখানে তারাই অংশগ্রহণ করতে পারবে যারা গাইতে পারে এবং তাদের নিয়ে এখান থেকে এমন একটি ‘ব্যান্ড’ (শব্দটি খেয়াল করবেন) গঠন করা হবে যাদের সবাই ভোকালিস্ট। এখন কথা হচ্ছে শুধু ভোকালিস্ট নিয়ে কখনোই ব্যান্ড গঠন করা সম্ভব না। ধরুন আপনি একটি ব্যান্ড করবেন যেটায় জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, পার্থ বড়ুয়া, বাপ্পা মজুমদার থাকবেন অথচ কোন ড্রামার কিংবা কোন বেইজিস্ট নেই। সাথে থাকবে বাজানোর জন্য একটি ব্যাকআপ ব্যান্ড। এখন আপনি কিভাবে এটাকে ব্যান্ড বলবেন? যারা শুধু কয়েকজন ভোকালিস্ট নিয়ে শো করে তাদের ‘ভোকাল গ্রুপ’ বলা হয়, ব্যান্ড না। কারণ তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ না। ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ, দ্য বিচ বয়েজ, বয়েজ II মেন – এদের মোটামুটি সবাই জানে এবং এরা হল ভোকাল গ্রুপ যারা কি না ব্যাকআপ ব্যান্ডের সাথে গান গায়। আবার এমন কিছু বিখ্যাত গার্ল গ্রুপও (Girl group) রয়েছে, যেমন স্পাইস গার্লস, ডেসটিনি’স চাইল্ড, দ্য সুপ্রিমস ইত্যাদি। এখন অনেকেই প্রশ্ন করে বসবেন, তাহলে ব্যান্ড আর গ্রুপ এর ভেতর পার্থক্যটা কি? পার্থক্যটা হল ইন্সট্রুমেন্টের। আপনি খেয়াল করে দেখবেন যে হিপ হপ মিউজিক যারা করে তাদেরকে হিপ হপ গ্রুপ বলা হয়, কোনভাবেই হিপ হপ ব্যান্ড বলা হয় না। সল্ট পেপা (Salt n Pepa), উইলসন ফিলিপস্ – এরা পপ গ্রুপ। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে, যেমন- ওয়ান ডিরেকশন। কিন্তু সংগীতের ভাষায় ব্যান্ড মূলত সেসব দল যারা কোন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে। তবে আরো বিশদ অর্থে ব্যান্ড বলতে বোঝানো হয় এমন গানের দলকে যেটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থাৎ যেখানে গায়ক বা ভোকালিস্ট থেকে শুরু করে যন্ত্রশিল্পী, সবই থাকে; আবার অনেক ব্যান্ডে শব্দ প্রকৌশলীও দেখা যায়। যেমন ধরুন- দ্য বিটলস্, পিঙ্ক ফ্লয়েড, লেড জেপলিন ইত্যাদি।
আরেকটি বিষয় হল অন্যান্য দেশেও ট্যালেন্ট হান্ট বা প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগীতা হয় যেমন- আইডল (সুইডেন), অ্যামেরিকান আইডল, পিনয় আইডল (ফিলিপাইন), হেই সুপারস্টার (আর্মেনিয়া)। প্রতিযোগীরা পরবর্তী সময়ে রেকর্ডিং আর অ্যালবাম করার চুক্তি পায়। তবে এরকম কিছু কখনও দেখিনি যে বিজয়ীদের নিয়ে ব্যান্ড তৈরী করা হয়। ব্যান্ড করতে চাইলে তারা ব্যাক্তিগতভাবে করতে পারে, কিন্তু নির্মাতারা করে দেবে এমন কিছু দেখা যায় না।
যে কথাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল এর আগেও Nescafe এরকম একটি আয়োজন করেছিল যেখানে বিজয়ীদের নিয়ে ব্যান্ড গঠন ও অ্যালবাম করার কথা ছিল। পরবর্তী সময়ে তেমন কোন অ্যালবাম বের হওয়ার খবর আমরা পাইনি। আর কোথায়ই-বা গেল সে ব্যান্ড? এগুলো যে বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় ব্রান্ডিং এর জন্য করা হয় সেটা মোটামুটি সবাই জানে এবং সেটা নিয়ে কোন ধরণের সমস্যাও নেই। যেটা ভাববার বিষয় সেটা হল এই অনুষ্ঠানগুলোর পরে এই শিল্পীরা কোথায় যায় আর তাদের অ্যালবাম-ই বা কোথায় ছাড়া হয়?
এ পর্যন্ত আমাদের দেশে শুধু ডিজুস রকস্টার (Djuice Rockster) অনুষ্ঠানটি থেকে হাতে গোনা ২-৩ টি ব্যান্ডকে (যেমন- পাওয়ার সার্জ, মেক্যানিক্স, রেডিও অ্যাক্টিভ) উঠে আসতে দেখেছি।
নারীদের নিয়ে এ উদ্যোগটিকে আমি মোটেও নিরুৎসাহিত করছি না বা নারী অগ্রগতিবিরোধী কোন কথা বলতে চাচ্ছি না। আমি আমার মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র, আমার কথাগুলোর পক্ষে বা বিপক্ষে আপনার মত থাকতেই পারে। আমি যা বলতে চাই তা হল, ব্যাপারগুলোতে আমাদের সবারই একটু সচেতন হওয়া উচিত। শুধু ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো আর স্পটলাইটে আসতে পারাটা সব কিছু নয়। যারা প্লাটফর্মের কথা বলে এগুলো করছেন তাদের বলতে চাই, ব্র্যান্ডিং এর জন্য কিছু ভুলভাল তথ্য আর সংজ্ঞা দিয়ে অখাদ্যকে খাদ্য বানিয়ে খাইয়ে না দিলেই নয় কি? ঘাসকে চকচকে মোড়কে খাইয়ে না দিলেই নয় কি?
Featured Image- Facebook
ব্যাপারটা আসলেও হাস্যকর।যেটা উপরে বলা হয়েচগে সেটার সাথে আমি একমত। অল গার্ল ক্রু হিসেবে বল্লেও পারত।কিন্তু ব্যান্ড শব্দটা আসলেও বেমানান!