সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে?

১১৬ বছরের লম্বা এক জীবন পাড় করেও নিজেকে রহস্যের আবর্তে জড়িয়ে নিজ কর্মগুণে যে মানুষটি আজও সকলের মাঝে বেঁচে আছেন তিনিই লালন সাঁই। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে ধর্ম-বর্ণ-জাতকে কেন্দ্র করে সারা পৃথিবী রক্তের বন্যা বইয়ে চলেছে সে প্রথাকেই তুরিতে উড়িয়ে দিয়ে নিজ সাধনাকে ধারণ করে জীবন পাড় করেছেন তিনি। জীবদ্দশায় যা ধারণ করেছেন মৃত্যুও তা খন্ডাতে পারেনি। চলে যাওয়ার এত বছর পরও পরিচয়, নিবাস এবং সংশ্লিষ্ট যা কিছু একজন মানুষকে অন্য মানুষের থেকে আলাদা করে, নির্দিষ্ট কোন গোত্রভুক্ত করে, সকলের সাথে ভিন্নতার রেখা তৈরি করে তার কিছুই পাওয়া যায়নি লালন সাঁই সম্পর্কে।

মীর জাহিদের আঁকা লালনের প্রতিকৃতি
মীর জাহিদের আঁকা লালনের প্রতিকৃতি, Source: offroadbangladesh.com

ফকির লালন, লালন ফকির, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন- সবই একজন মানুষের পরিচয় বহন করে, কোন গোত্র বা ধর্মবিশ্বাসের নয়। সারাজীবন ধারণও করেছেন মানুষকে, মানুষের ভালোবাসাকে। আর তাই তাঁর রেখে যাওয়া কর্মের মাঝে নিতান্তই নিজ নামের ব্যবহার ছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ের কোন তথ্যই উদ্ধার সম্ভব হয়নি আজও। লালন সাঁইয়ের গানে আছে সৃষ্টির রহস্য নিয়ে প্রশ্ন, আছে দেহতত্ত্বের কথা। আছে সমাজের ভণ্ডামি আর দ্বিচারিতা নিয়ে স্পষ্ট প্রশ্নবাণ। তার গানে তিনি বলে যান-

‘গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়
লালন বলে জাত কারে কয়
সবই দেখি তা না না না
জাত গেলো জাত গেলো বলে
একি আজব কারখানা’

১৭৭৪ সালে জন্মগ্রহণ করা লালনের ব্যক্তি পর্যায়ের একমাত্র সুনির্দিষ্ট বিবরণ তার সংগৃহীত গান। এছাড়া জন্মস্থান থেকে শুরু করে ধর্ম, পরিবারের মতো প্রশ্নগুলোতে সাঁই এবং ভক্তদের কঠিন নীরবতা তৈরি করেছে মতভেদ। সাঁইয়ের মৃত্যুর পনেরো দিন পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত ‘হিতকরী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, “ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশতঃ কিছুই বলিতে পারে না”। আবদুল ওয়ালীর মতে, অবিভক্ত বাংলার যশোহরের ঝিনাইদহ মহকুমার হারিশপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহন করেন। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র দাবী অনুযায়ী, সাঁই কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। এছাড়া ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের মাসিক মোহম্মদী পত্রিকার আষাঢ় সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে যশোহরের ফুলবাড়ী গ্রামকে সাঁইয়ের জন্মস্থান বলে উল্লেখ করা হয়। একইভাবে তাঁর জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মবিশ্বাস নিয়েও রয়েছে নানা মতভেদ। কোন গবেষক বলেন তিনি ছিলেন মুসলমান, আবার কেউবা বলেন তিনি ছিলেন হিন্দু। তবে শিষ্যদের ভাষ্যমতে তাকে কখনো কোন ধর্মীয় আচার পালন করতে দেখা যায়নি। গানেও তিনি বলেছেন-

এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে

তবে সাঁইয়ের কর্মে বারবার ‘মনের মানুষ’কে স্মরণ করাকে বিশ্লেষণ করলে স্রষ্টায় বিশ্বাস ছিল না এ কথাটিও ঠিক গ্রহণযোগ্য হবে না। সমাজ পরিচালিত তথাকথিত বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে জাত মানতে না চাইলেও অন্তর্যামিতে বিশ্বাস ছিল সাঁইয়ের। তাইতো গেয়েছেন-

আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়
পাড়ে লয়ে যাও আমায়

তিনি বিশ্বাসী ছিলেন, তবে তা স্রষ্টা আর সৃষ্টিতে। সেখানে সমাজের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের কোন জায়গা ছিল না। বাস্তবতা হলো সাঁই নিজেকে পরিচয়ের গণ্ডিতে বাঁধতে না চাইলেও মানুষমাত্রই স্বাভাবিক জাত-বৈশিষ্ট্যে তাকে বাঁধতে চাওয়ার প্রবণতা থেকে বেরোতে পারেননি বাকিরা। আর তাই তাকে নিয়ে চলেছে রাজনীতিও।

লালনের শিষ্যদের সমাধি
লালনের শিষ্যদের সমাধি Source: hotelroyalintl.com

লালন সাঁই লিখতে বা পড়তে জানতেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তাঁর গানের সহজ শব্দে গূঢ় ভাব, গভীর আমেজ এবং ভাবনার গভীরতা তারই সত্যতা বহন করে। আর তাই সমাজ যে নিয়ত চক্রে নিজেদের বেঁধে তদানুযায়ী মানুষকে পরিচালনার দায় চাপিয়ে দিয়েছিলেন তা সাঁই মেনে নেননি। বিশ্বাসের ওপরে যুক্তিকে, ধর্মের ওপর মানুষকে এবং সমাজের ওপরে মানবজীবনকে স্থান দিয়েছেন তিনি। তাই তিনি গাইতে পেরেছেন-

লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।।
কেউ মালায় কেউ তসবি গলায়,
তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়।
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়,
জাতের চিহ্ন রয় কার রে।।

ছেউড়িয়ায় আখড়ার এই ঘরেই সমাহিত করা হয় লালনকে
ছেউড়িয়ায় আখড়ার এই ঘরেই সমাহিত করা হয় লালনকে; Source: kushtiamunicipality.org

বাউল সম্রাটের মুকুট পরিহিত সাঁই নিজেকে কখনো ফকির ভিন্ন অন্যকিছু দাবি না করলেও কেন তাকে এ বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয় সে তর্ক অবশ্যই গবেষণার বিষয়। তবে সাঁই অন্য দশজন থেকে আলাদা হয়েছেন তাঁর জীবন-দর্শনের জন্যে। তিনি শুধু গানই বাঁধেননি, সাথে দেখেছেনও। সেই দেখাকে উপজীব্য করে প্রশ্ন তুলেছেন অনবরত। জীবনকে দেখার এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যই তাকে লালন সাঁই করে তুলেছে। সমাজের প্রচলিত ধারণায় একজন অশিক্ষিত বাউল দু’শো বছর পরও যে অবস্থানে আছে তাঁর পেছনে কাজ করেছে তাঁর সমাজসচেতন, মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি। বাউল গানের মৌলিকত্বকে ভেঙ্গে মানুষকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের একটি হাতিয়ার করে তুলেছেন গানকে। সামাজিক তাৎপর্য ও মানবিক বিশ্বাসে সমৃদ্ধ সে গান শুধু নিজেকে তৃপ্ত করতে গাননি সাঁই। বরং তাঁর শিষ্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দিয়েছেন সে দর্শন। ছেউড়িয়ার আখড়াতেই ছোট্ট এক কুটিরে বসে আত্মদর্শন ও আধ্যাত্মিকতার দিব্যবানী দিয়েছেন শিষ্যদের। জ্ঞানবাদ, আত্মতত্ত্ব ও দেহ তত্ত্বের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন এবং অন্তর্মূখী অবস্থাকে ব্যাখ্যা করেছেন সাঁই। গেয়েছেন-

জগৎ বেড়ে জাতের কথা
লোকে গৌরব করে যথাতথা
লালন সেই জাতের ফাতা
বিকিয়েছে সাত বাজারে

লালন সাঁই গুরুবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। সিরাজ সাঁইয়ের অধীনে তিনি দীক্ষা নেন। ১৮৯০ সালের ৩১ অক্টোবর মীর মোশাররফ হোসেনের ‘হিতকরী’ পত্রিকায় বলা হয় “লালন বড় গুরুবাদ পোষণ করিতেন”। লালনের কর্মে বাউলসাধনার এ অংশটি অত্যন্ত গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে।

লালন উৎসবে গান গাচ্ছেন রাজ্জাক বাউল
লালন উৎসবে গান গাচ্ছেন রাজ্জাক বাউল © SC Photography

সাঁইয়ের গান লিপিবদ্ধ করেছে তাঁর শীষ্যরা। সাঁইয়ের গান শুনে শুনে মনে রেখে পরবর্তী সময় লিপিকারকে দিয়ে লিপিবদ্ধ করা হতো। ফলে অনেক গানই যে হারিয়ে গেছে তা বলাবাহুল্য। তাঁর গানের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও সহস্রাধিক হবে বলে অনুমান করা যায়। তবে এ-যাবত সংগৃহীত তাঁর প্রামাণ্য গানের সংখ্যা সাতশোর বেশী না। পরবর্তী সময় বিভিন্ন ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে সাঁইয়ের গান সংগ্রহ ও সংরক্ষিত করেন। তাদের মাঝে রবীন্দ্রনাথসহ ঠাকুর পরিবারের বিভিন্ন সদস্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। এছাড়া সাঁইয়ের জীবদ্দশায় অঙ্কিত একমাত্র স্কেচটি তৈরী করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত এ পেন্সিল স্কেচটি লালনের মৃত্যুর বছরখানেক আগে ৫ মে ১৮৮৯ সালে আঁকা হয়। অনেকের দাবী এই স্কেচটিতে সাঁইয়ের আসল চেহারা ফুটে ওঠেনি। ব্যক্তিগতভাবে সাঁইয়ের কাজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ নিজক্ষেত্রে খ্যাতনামা অনেককেই প্রভাবিত করে। এলেন গিন্সবার্গ তাদের মধ্যে অন্যতম। After Lalon নামে একটি কবিতাও রচনা করেন তিনি।

কুষ্টিয়ার কুমারখালির কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের সাথে সাঁইয়ের ঘনিষ্ঠতা ছিল। কথিত আছে কাঙাল হরিনাথের প্রকাশিত পত্রিকা গ্রামবার্তা প্রকাশিকার একটি সংখ্যায় ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা নিপীড়নের সংবাদ ও তথ্য প্রকাশের সূত্র ধরে উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মকর্তারা বিষয়টির তদন্তে প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানে এলে কাঙাল হরিনাথের ওপর ক্ষুব্ধ হওয়া ঠাকুর-জমিদাররা তাঁকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে লাঠিয়াল পাঠালে শিষ্যদের নিয়ে সাঁই সশস্ত্রভাবে জমিদারের লাঠিয়ালদের মোকাবিলা করেন।

১৮৯০ সালে সাঁই দেহত্যাগ করলে তাঁর নির্দেশনা অনুসারে ছেউড়িয়ায় আখড়ার একটি ঘরের ভিতর তাকে সমাহিত করা হয়। প্রতি বছরই সাঁইয়ের প্রয়ান দিবসে সারা দেশ থেকে ভক্ত বাউলেরা ছেউড়িয়ায় মিলিত হয়ে সাঁইয়ের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

লালন উৎসবে জড়ো হয় লালনের ভক্তরা
লালন উৎসবে জড়ো হয় লালনের ভক্তরা; Source: Facebook

লালন সাঁইয়ের কাজ আজ বড় বড় মানুষদের গবেষণার বিষয়- অথচ ব্যক্তি সাঁইয়ের আদর্শ ছাড়া সবটাই সেখানে অধরা। সাঁই বেঁচে থাকবেন তার কাজের মাঝে, তথাকথিত সমাজ দ্বারা নির্ধারিত কোন স্তরে নিজেকে তিনি বাঁধেননি। সাঁই ধারণ করেছেন মানুষকে, মানুষের ওপর করা বিশ্বাসকে- তথা মানবতাকে। সাঁই কোন সম্প্রদায় কিংবা গোত্রের না, সাঁই সকল মানুষের। যে মানুষ সমাজ আর ধর্ম নামক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আঙুল দেখিয়ে সত্যকে ধারণ করেছে সাঁই তার। সাঁই মানেই সত্যের আদর্শ, লালন মানেই অমরত্ব।

Featured Image: Compiled
This biographical write-up in Bengali is about the self-taught legendary philosopher folk singer and composer, a human beyond all class-race-religion, Lalon Sai. The references are hyperlinked into the write-up.
Previous articleমহীনের ঘোড়াগুলি ও বাংলা সংগীতের ম্যাজিসিয়ান গৌতম চট্টোপাধ্যায় (পর্ব ২)
Next articleবাংলাদেশে ইয়ামাহা মিউজিকের যাত্রা শুরু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.