হারিয়ে যাওয়া প্রিয় পুরনোকে খুঁজে পেলে যে অনুভূতি হয় ঠিক তেমনি অনুভব করেছিলাম সেদিন। এ্যালিফেন্ট রোডে, মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের উল্টো দিকের গলিতে বারকয়েক চক্কর আর আশেপাশের বেশ কিছু দোকানে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরও যখন খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন প্রায় হতাশ হয়েই বি. এস. ভবনের পেছনের পথে এগিয়ে গেলাম। প্রবেশ পথে এক কম্পিউটারের দোকানে জিজ্ঞেস করতেই একটু আশার আলো দেখা গেল। এই ভবনে নাকি একটা সিডির দোকান আছে। সামনে এগুতেই চোখে পড়লো সেই নাম। আর মুহূর্তেই যে অদ্ভুত চাপা উত্তেজনা অনুভব করছিলাম সেটা প্রকাশ করার মতো উপযুক্ত শব্দ আমার কাছে নেই। বলছি রেইনবো’র কথা।
দেশের রক সংগীত বা ব্যান্ডগুলো সম্পর্কে যাদের আগ্রহ আছে তাঁরা নিশ্চয়ই বিভিন্ন সময় রেইনবো ও কবির ভাই-এ নাম দুটি শুনে থাকবেন। তাই আপনাদের রেইনবোর সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। যারা শোনেননি তাদের উদ্দেশ্যে বলছি- রেইনবো অনেকের কাছেই শুধু একটা সিডির দোকান। কিন্তু সেটা বললে ভুল হবে। কেননা শুধু সিডি নয়, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে সংগীত বিপণন করেছে রেইনবো। আর সংগীত ছাড়াও আনুষঙ্গিক কিছু জিনিসপত্র পাওয়া যেতো রেইনবোতে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো আমাদের দেশের ব্যান্ডগুলো ও তাঁদের সংগীত আজ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে রেইনবো না থাকলে হয়তো এ অবস্থানে পৌঁছাতে আরো কয়েক দশক লেগে যেতো। অথবা বলা যায়, হয়তো সংস্কৃতিটা এভাবে গড়েই উঠতো না।
রেইনবোর সন্ধান
রেইনবোকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার শুরু একটা ঘড়ির মাধ্যমে। হ্যাঁ, দেয়াল ঘড়ি! যদিও ব্যাপারটা একটু নাটকীয়; লেড জেপলিন ব্যান্ডের এলপি (লং প্লে) দিয়ে তৈরি একটি দেয়াল ঘড়ি। ঢাবি’র গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রফেসর ড. নাদির জুনাইদের সংগ্রহে ঘড়িটি দেখি। দেখে বেশ অবাকই লেগেছিলো। যে শহরে ’৯০ এর দশকের ইংরেজি গানের অ্যালবাম তো অনেক দূরের ব্যাপার বাংলা গানের অ্যালবাম পাওয়াই দুষ্কর সেখানে লেড জেপলিনের এলপি দিয়ে তৈরী করা ঘড়িটি সত্যিই অবাক করার মতোই ছিলো।
দেখা মাত্রই স্যারের কাছে ঘড়িটি সম্পর্কে জানতে চাইলাম। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় পেয়েছেন এটি? তিনি রেইনবোর কথা জানালেন। শুনে যেন নিজের ভেতরে একটা ধাক্কা লাগলো! এ ধাক্কাটা ছিলো বিস্ময়ের। তখনও নিশ্চিত ছিলাম না অনেকের থেকেই শোনা আর সংগীত বিষয় নানা আর্টিকেল/লেখা পড়তে গিয়ে অসংখ্যবার মখোমুখি হওয়া সেই রেইনবোই এ রেইনবো কিনা। স্যারের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলাম এটিই সেই রেইনবো এবং এখানেই কবির ভাই বসতেন।
রেইনবো
‘রেইনবো’ বাংলাদেশের সংগীত জগতে এমন একটি নাম যেটি না থাকলে হয়তো শ্রোতা ও শিল্পীদের একটি প্রজন্মই তৈরি হতো না। এই যে এখনকার প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা লাইভ কনসার্টে বাংলা ও ইংরেজি গানের তালে মেতে উঠছে, হেড ব্যাং আর মসপিট করছে হয়তো এর কিছুই হতো না। এখন যেমন ইউটিউব ও অন্যান্য অনলাইন সোর্স থেকে সহজেই লাইভ কনসার্ট দেখার পাশাপাশি গান শোনা ও ডাউনলোড করা যায়, আজ থেকে দশ বছর আগেও বিষয়টা কিন্তু এতোটা সহজ ছিলো না। তাহলে আশি-নব্বইয়ের দশকে অবস্থাটা কেমন ছিলো তা কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। তখন দেশি বা ভারতীয় শিল্পীদের কিছু অ্যালবাম পাওয়া গেলেও ইংরেজি গান, বিশেষ করে ব্যান্ডের গান শুনতে হলে অ্যালবাম সংগ্রহ করতে হতো দেশের বাইরে থেকে। রেইনবোই তখন প্রথম ঢাকায় পশ্চিমা (western) শিল্পী ও ব্যান্ডের গান আনতে শুরু করে।
পশ্চিমা সংগীতের প্রতি ভালোলাগা থেকেই আব্দুল কাদের মুরাদ, তাঁর বোন এবং ফিরোজ – নিজেদের মতো শ্রোতাদের কথা ভেবে, ঢাকায় পশ্চিমা গানের একটি সংগ্রহশালা করতে চান। সেই সুবাদে ১৯৮১ সালের ৭ আগস্ট আব্দুল কাদের মুরাদ প্রতিষ্ঠা করেন রেইনবো। পরে তাঁর সাথে যুক্ত হন হুমায়ন কবির (কবির ভাই)।রেইনবোর স্বত্ত্বাধিকারী আব্দুল কাদের মুরাদ মূলত একজন ব্যবসায়ী হলেও পশ্চিমা সংগীতের প্রতি ভালোবাসা থেকেই শখের বশে প্রতিষ্ঠা করেন এটি। প্রতিষ্ঠার প্রায় চার দশক পার করে এখনও সেই এ্যালিফেন্ট রোডেই দাঁড়িয়ে আছে রেইনবো। আগের মতো বৃহৎ পরিসরে অবস্থান না করলেও এখনও গান বাজে ঠিক আগের মতোই। ২০০২ সাল থেকে বি. এস. ভবনের (৭৫-৭৬ সায়েন্স ল্যাবরেটরি রোড) নিচ তলায় অবস্থান এটির।
বর্তমানে রেইনবোতে দশ হাজারেরও বেশি পশ্চিমা সংগীতের আলবাম (সিডি) আছে। রেইনবোর শুরুটা হয়েছিলো এলপি থেকে ক্যাসেটে গান কপি করার মধ্য দিয়ে। এরপর আসে সিডি। এখনো সেই সিডিতে করেই গান দেয়া হয়। আশির দশকে পশ্চিমা গানের এলপিগুলো সংগ্রহ করতে হতো বিদেশ থেকে। তাই কাজটা মোটেই সহজ ছিলো না। রেইনবোর অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলো বলেই সে সময়ে এলপিগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিলো। এয়ারলাইনস এবং বিভিন্ন দেশে আনাগোনা ছিলো এমন শুভাকাঙ্ক্ষিদের মাধ্যমে এলপি সংগ্রহ করতো রেইনবো। আবার অনেকে স্বেচ্ছায় নিজের সংগ্রহে থাকা এলপি রেইনবোতে দিয়ে দিতেন বলে জানান রেইনবোর বর্তমান সেলস্ মেনেজার মোকলেছুর রহমান মুকুল। ১৯৯৪ সাল থেকে তিনি রেইনবোতে আছেন। তিন বেলা আহারের মতোই সংগীত তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে “এটা পার্ট অভ লাইফ। তার কারণ হচ্ছে গান শুনলে ব্যক্তিগত ঝামেলাসহ নানা ধরনের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকি। অন্য কোনো চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘোরার চেয়ে মিউজিক শোনা ভালো।”
পাঠক, আপনি রেইনবোতে আসলে হয়তো একটু অবাক হবেন। এখানে অসংখ্য ওয়েস্টার্ন গানের অ্যালবাম চোখে পরলেও খুঁজে পাবেন না কোনো বাংলা গানের অ্যালবাম। এ ব্যাপারে মুকুল বলেন, “এটা একটা ঐতিহ্যের মত।” আশি-নব্বইয়ের দশকে বাংলা গান ও অন্যান্য বাংলা কন্টেন্ট (সাংস্কৃতিক উপাদান অর্থে) সবখানে সহজলভ্য হলেও পশ্চিমা গানগুলো সহজে পাওয়া যেত না। তিনি আরো বলেন, মুরাদ ভাই ও কবির ভাই প্রায়ই বলতেন, “যারা পশ্চিমা সংগীত ভালোবাসে, এর প্রকৃত শ্রোতা তাঁরা আমাদের কাছে আসবে। আমাদের কোনো মার্কেটিং এর দরকার নেই, তাঁরাই আমাদের খুঁজে নেবে।”
রেইনবোর আড্ডা
দীর্ঘ দিন ধরে রেইনবোতে থাকার সুবাদে অনেক কিছুরই সাক্ষী হয়ে আছেন মুকুল। সংগীতকে কেন্দ্র করে যে আড্ডা বসতো সেটি হতো তাঁরই সমনে। এই আড্ডা থেকেই গড়ে উঠেছিলো পশ্চিমা সংগীত দ্বারা প্রভাবিত এক প্রজন্ম। আড্ডায় অংশগ্রহণ করতো সংগীতপ্রেমী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণী ও উঠতি মিউজিশিয়ানরা। উঠতি মিউজিশিয়ানদের মধ্যে ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু, জেমস্, ওয়ারফেইজের গিটারিস্ট ইব্রাহিম আহমেদ কমল, গাছ ব্যান্ডের সাহেদসহ আরো অনেক নাম করা মিউজিশিয়ান। বিভিন্ন লেখালেখি থেকে জানা যায় আইয়ুব বাচ্চু ঢাকায় আসার পর প্রথম দিকে এ্যালিফেন্ট রোডে থাকতেন। সেসময়ই রেইনবোতে তাঁর যাতায়াত ছিলো। এলআরবির বেইজিস্ট স্বপনও নিয়োমিত যেতেন রেইনবোতে। রেইনবো ছিলো একটা হাবের (hub) মতো, বিভিন্ন বয়সের আর পেশার সংগীত প্রেমিদের সমাগম ঘটতো সেখানে। দেখা যেতো পেশাদার সংগীত শিল্পীদের সাথে হয়তো নিঃসংকোচে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে সদ্য কলেজ পড়য়া কিছু তরুণ। গান নিয়ে সেখানে হতো তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা। কোন গানের কমপোজিশনটা কেমন, কোন গিটারিস্ট কীভাবে কী বাজান, গানে কোন সাউন্ড ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছে, গিটারের টোনটা কেমন, মাস্টারিং এর কারসাজি ধরার চেষ্টা, লিরিক্সটা কতটা কাব্যিক কিংবা এর অর্থ কী দাঁড়ায় তা নিয়ে হয়ে যেতো গবেষণা– কিছুই যেন বাদ যেতো না আড্ডা থেকে! কেউ গিটার নিয়ে আসলে আড্ডার ফাঁকে হয়ে যেতো গান। তখন ঢাকায় সংগীত নিয়ে জ্ঞানচর্চা করার তেমন কোনো কেন্দ্র ছিলো না। ছিলো না কোনো মিউজিক ক্যাফে যেখানে আড্ডা বসতে পারতো কিংবা কোনো সংগীত বিষয়ক ম্যাগাজিন অথবা ইন্টারনেট। তাই রেইনবোই হয়ে উঠেছিলো সংগীত বিষয়ক নিত্য আড্ডা ও জ্ঞান আদান-প্রদানের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। বিখ্যাত সে আড্ডায় অন্যতম নাম ছিলো কবির ভাই।
কবির ভাই
‘কবির ভাই’ নামটা অনেকেরই পরিচিত। রক সংগীত অথবা ব্যান্ডের সাথে জড়িত যেসব মিজিশিয়ানদের বেড়ে ওঠা ঢাকায় বা যারা আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে ঢাকায় আছেন, তাদের মধ্যে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কবির ভাইয়ের কথা বলেননি এমন মিজিশিয়ানের সংখ্যা কমই আছে। রেইনবোর সাথে শুরু থেকে থাকা এই কবির ভাই অনেকের কাছে ছিলেন এক জীবন্ত মিউজিক এনসাইক্লোপিডিয়া। স্যাটেলাইট চ্যানেল কিংবা ইন্টারনেট না থাকলেও ছিলেন কবির ভাই। তাই সংগীত বিষয়ক তথ্যের অভাব বোধ করতো না সংগীত অনুরাগী তরুণরা। কবির ভইয়ের কাছে থাকতো সব ধরণের তথ্য। কোন ব্যান্ডের অ্যালবাম বের হলো, কোন ব্যান্ডের গিটারিস্ট কে, কোন ব্যান্ডের কোন সদস্য বদল হচ্ছে, কোন ব্যান্ড ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বের হচ্ছে ইত্যাদি নানান তথ্য পাওয়া যেতো তাঁর কাছে। আর এই কারণেই তরুণদের কাছে সমাদর ছিল কবির ভাইয়ের। এছাড়া তাঁর হিপি (hippy) স্টাইলও আকৃষ্ট করত তরুণদের।
প্রায় দু’দশক হতে চললো কবির ভাইকে আর রেইনবোতে দেখা যায় না। এখন তিনি অস্ট্রেলিয়াতে অবস্থান করছেন। কারো সাথে খুব একটা যোগাযোগ হয় না তাঁর। যতদুর জানা যায় তিনি ২০০১ সালে দেশ ছেড়ে চলে যান এবং তখন থেকেই স্বপরিবারে অস্ট্রেলিয়াতে আছেন। ২০০৫ সালে তাঁকে আরও একবার রেইনবোতে দেখা গিয়েছিলো এক পুনর্মিলনীতে।
অডিও এর পাশাপাশি
শুধু অডিও অ্যালবাম নয় বিভিন্ন সময়ে আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কিছু পাওয়া গেছে রেইনবোতে। যেমন- ব্যান্ডের টি-শার্ট, পোস্টার, সুভেনিয়ার ইত্যাদি। ২০০৫ সালের দিকে লাইভ কনসার্টের ডিভিডি পাওয়া যেতো রেইনবোতে। একটা ম্যাগাজিনও বের করেছিলো রেইনবো। নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে বের হওয়া ম্যাগাজিনটি ছিলো ইংরেজিতে করা। এটিতে লেখা-লিখি করেছিলেন রেইনবোর শুভাকাঙ্ক্ষীরাই। ম্যাগাজিনটির কেবল একটি সংস্করণই বের হয়েছিলো। নব্বয়ের দশক থেকে যারা এখানে নিয়মিত আসেন তাঁদের অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে ম্যাগাজিনটি বেশ ভালো সাড়া ফেলেছিলো সে সময়ে।
আজম খান বা আইয়ুব বাচ্চু কেউই আজ আর আমাদের মাঝে নেই। আজম খান আমাদের দেশে সংগীতের বিপরীত ধারার যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন সেটি এগিয়ে নিয়ে গেছেন আইয়ুব বাচ্চুর মতো শিল্পীরা। রেইনবোর মতো প্রতিষ্ঠান ছিলো বলেই হয়তো সে সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তাঁরা। আজকাল আর কোনো কিছুই আগের মতো কষ্ট করে পেতে হয় না। মাউসের ক্লিকেই দুনিয়া হাজির। তাই সবকিছুর মূল্যও যেন আমাদের কাছে কম। সহজিয়ার গানের মতোই সবসময় যেন আমাদের মাঝে “চাই আরও কিছু, আরও কিছু” একটা মনোভাব বিরাজ করে। আমরা কোনো কিছুর পিছনেই সময় দিতে চাই না, আবার পেলেও তা আঁকড়ে ধরি না। শখ, চাওয়া বা অজর্ন সবকিছুই যেন সস্তা হয়ে গেছে। কিছু একেবারে হারিয়ে গেলেই কেবল তার মূল্য উপলদ্ধি করি আমরা। কালের বির্বতনের হয়তো একদিন আজম খান বা আইয়ুব বাচ্চুর মতো রেইনবোও হারিয়ে যাবে। কিন্তু আজও বাংলাদেশে রেইনবোই সেই একমাত্র স্থান “Where the Music Never Stopped.”