সত্তরের দশকে নিজেদের ভাষা ও অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে একদিকে যখন দেশের মানুষ যুদ্ধ করছিলো তখন অন্যদিকে বিশ্ব রক সংগীতের ইতিহাসে লেখা হয়েছিলো বাংলাদেশের নাম। লাইভ এইড, ফার্ম এইড, কনসার্ট ফর কম্পুচিয়া ইত্যাদির মত বৃহৎ দাতব্য কনসার্টগুলোর আগে ১৯৭১ সালে আয়োজিত হয়েছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। বলা হয়ে থাকে বৃহৎ পরিসরে আয়োজিত প্রথম দাতব্য কনসার্ট এটি। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর মাধ্যমে রাতারাতি অসংখ্য মানুষ জেনেছিলো বাংলাদেশের সংকটের কথা। কনসার্টটি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে অনন্য এক ভূমিকা রেখেছিলো। কনসার্টটির পেছনে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি সেতার বাদক পণ্ডিত রবিশংকর। আর অবদান ছিলো এক্স-বিটোল গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসনের।

’৭০ এ ভোলায় হয়ে যাওয়া ভয়াবহ ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস (সাইক্লোন) আর ’৭১ এ দেশে গণহত্যা-যুদ্ধের ফলে অভাব-অনটন ও প্রাণ ভয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে দেশ ত্যাগ করে লাখ লাখ মানুষ। ভারতে আশ্রয় নেয় প্রায় এক কোটি মানুষ। শরণার্থীদের অধিকাংশই ছিলো মহিলা ও শিশু, সেখানে পর্যাপ্ত খাদ্য ও চিকিৎসার অভাব ছিলো। কলেরার মত রোগগুলো সেখানে মহামারি আকারে দেখা দেয়, প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছিলো এবং শিশু মৃত্যু হার ক্রমেই বেড়ে যায়। বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানকে (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান) অস্ত্রসহ সব ধরনের সহযোগিতা করছিলো।
পণ্ডিত রবিশংকরের পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশে। তাঁর জন্ম এক বাঙালি পরিবারে। যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে পণ্ডিত রবিশংকর বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানতে পারেন। শিকড় যে দেশে সে দেশের এমন সংকটাপন্ন অবস্থা দেখে স্থির থাকতে পারেননি রবিশংকর। তিনি চাইছিলেন বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে। তাঁর পরিকল্পনা ছিলো একটি দাতব্য কনসার্ট করার যা থেকে অন্তত ২৫ হাজার ডলার সংগ্রহ করা যায়। তিনি তাঁর বন্ধু ও শিষ্য জর্জ হ্যারিসনকে বাংলাদেশের সংকটের কথা জানান এবং কনসার্ট নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা বলেন। এটি আয়োজনের ব্যাপারে তিনি হ্যারিসনের সাহায্য চেয়েছিলেন।

বাংলাদেশের এ দুর্বিসহ অবস্থা হ্যারিসনকেও নাড়া দেয়। তাই বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে কনসার্টটির জন্য কাজ শুরু করেন। হ্যারিসন তাঁর বই ‘আই-মি-মাইন’-এ লিখেছেন কিভাবে তিনি পরবর্তী তিন মাস টেলিফোনে যোগাযোগ করে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর জন্য মিউজিশিয়ানদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন। সাবেক বিটোলদের মধ্যে শুধু রিঙ্গো স্টারই এ কনসার্টে যোগ দেন। জন লেনন-এর যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত যোগ দেননি। ইরিক ক্লাপটন, বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল, বব ডিলান, ব্যাডফিঙ্গারসহ আরও শিল্পীদের এ কনসার্টে যোগ দিতে অনুরোধ করেন হ্যারিসন।
২৭ জুলাই প্রস্তুতি যখন প্রায় শেষের দিকে তখন এক প্রেস কনফারেনসের মধ্য দিয়ে হ্যারিসন ও রবিশংকর কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর ঘোষণা দেন। একই দিনে হ্যারিসন তাঁর ‘বাংলা দেশ’ গানটি মুক্তি দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সংকটের কথা তুলে ধরেন।

১ আগস্ট ১৯৭১ সালে নিউইর্য়কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। সেদিন দুটো কনসার্টের আয়োজন করা হয়- প্রথমটি দুপুর ২:৩০ মিনিটে এবং দ্বিতীয়টি সন্ধ্যা ৮:০০ টায়। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এ খ্যাতনামা তারকাদের নিয়ে করা লাইনআপকে বলা হয়েছিল ‘সুপার গ্রুপ’। এ লাইনআপে ছিলেন জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশংকর, আলী আকবর খান, আল্লা রাখা, কমলা চক্রবর্তী, রিঙ্গো স্টার, ইরিক ক্লাপটন, বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল, ক্লাউস ভোরম্যান, জিম কেল্টনার, ব্যাডফিঙ্গার,বব ডিলানসহ আরো মিউজিশিয়ান। সেদিন ম্যাডিসন স্কয়ারের বাইরে হয়েছিল এক আশ্চর্যজনক ব্যাপার, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যুদ্ধে পাকিস্তানকে আর্থিক ও সামরিক সহযোগিতা প্রদান করছিল সেখানে সে দেশের মানুষই কনসার্ট ভেনুর বাইরে নিজ উদ্যোগে বাংলাদেশের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছিলো।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অনুষ্ঠানে আগত দর্শক-শ্রোতাদের হ্যারিসন ধন্যবাদ জানানোর পর কনসার্টটি শুরু হয় পণ্ডিত রবিশংকর ও তাঁর দলের ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। তাঁরা বাজিয়েছিলেন কনসার্টের জন্য বিশেষভাবে তৈরি ‘বাংলা ধুন’ ও অন্যান্য পরিবেশনা। তাঁদের ৪৫ মিনিটের পরিবেশনা শেষে একটি সংক্ষিপ্ত বিরতি দেয়া হয়। বিরতিতে নেদারল্যান্ডের এক টিভি চ্যানেলের ধারণ করা বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংসতা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফুটেজ দেখানো হয়। এ ফুটেজটি উপস্থিত দর্শকদের বাংলাদেশে চলা সংকটের এক বাস্তব ধারণা দেয়। এরপর ছিল হ্যারিসনের পরিবেশনা, তাঁর সাথে ছিলেন রিঙ্গো স্টাড়, ইরিক ক্লাপটন (যিনি অসুস্থ ছিলেন), বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল, ক্লাউস ভোরম্যান, জিম কেল্টনারসহ ১৮ জন মিউজিসিয়ান। এটি ছিল হ্যারিসন ও ক্লাপটনের বেশ কয়েক বছর বিরতির পর প্রথম কোন কনসার্টে পরিবেশনা। এরপর ছিল প্রায় অনিশ্চিত ডিলানের পরিবেশনা। হ্যারিসনের ‘বাংলা দেশ’ গানটি দিয়ে প্রথম কনসার্টটি শেষ হয়।

কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রথম কনসার্টটির সব টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়ায় হ্যারিসন, ডিলানসহ সকলে অনেক উত্সাহের সাথে দ্বিতীয় কনসার্টটি করেন। দ্বিতীয় কনসার্টটিতে পরিবেশন-তালিকায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। এবারও কনসার্টের সব টিকিট বিক্রি হয়ে য়ায় এবং কনসার্ট শেষে ডিলান হ্যারিসনকে বলেছিলেন, “আমরা হয়ত আরো একটি কনসার্ট করতে পারতাম।”

পণ্ডিত রবিশংকরের ধারণা ছিলো কনসার্ট ফর বাংলাদেশ থেকে অন্তত ২৫ হাজার ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব হবে, তবে দুটি কনসার্ট শেষে ২৪৩,৪১৮.৫০ ডলার উঠে আসে। কনসার্ট থেকে সংগ্রহ করা অর্থ ১২ আগস্ট ইউনিসেফ-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিলো যা দিয়ে শরণার্থী শিবিরে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ থেকে যে শুধু অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে তা নয়, বিশ্ব জনমত গঠনের ক্ষেত্রে এক বিরাট ভূমিকা রেখেছে কনসার্টটি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে যেখানে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিবেদন হয়েছিলো, সেখানে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই কনসার্টটি। রবিশংকর এ কনসার্ট সম্পর্কে বলেন, “এক দিনেই সকলে বাংলাদেশের নাম জেনে যায়………এটা ছিল আলৌকিক”।

জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশংকরসহ সুপার গ্রুপের সকল শিল্পীর মানবতার তাগিদে করা এ কনসার্টটি না হলে হয়ত কয়েক লক্ষ শরণার্থীকে স্বাধীন ভূখণ্ডে ফেরার স্বপ্ন নিয়ে মরতে হতো অন্যের ভূখণ্ডে। হয়ত স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্ববাসীর সমর্থন বা সহায়তা কোনোটাই পেতো না বাংলাদেশ। স্কুলে পড়ার সময় প্রথম ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ সম্পর্কে জানতে পারি একটি ট্রিবিউট শো-এর মাধ্যমে। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে অনুষ্ঠানটির। এখন আর এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠান হয় না। আমাদের প্রজন্মের অনেকে আজ ভুলতে বসেছে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ কী। আর এ প্রজন্মের অনেকেই জানে না এ বিষয়ে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগীতের বিশাল এ অবদান আমরা কি এত সহজেই ভুলে যাবো?